মৌলবাদ আমাদের ভবিষ্যৎ : কিছু যুক্তিবাদী চিন্তা।

প্রায় পঞ্চাশ বছর সময়কাল ধরে ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বা ‘মৌলবাদ’ সারা পৃথিবী জুড়ে এমনই এক ‘ফেনোমেনন’ হয়ে দেখা দিয়েছে, কোনও চিন্তাশীল মানুষই যাকে আর উপেক্ষা করতে পারেন না। ইউরোপে রেনেসাঁ, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব, এনলাইটেনমেন্ট, শিল্প বিপ্লব এইসব ঘটে যাবার পর থেকে আলোকপ্রাপ্তদের মনে ক্রমশ এই ধারণাটাই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছিল যে, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি অর্থনীতি এইসবের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের প্রভাব আস্তে আস্তে কমে আসবে, এবং এক সময়ে হয়ত তা পুরোপুরিই অবলুপ্ত হয়ে যাবে। সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণার প্রচার ও প্রসারের ফলে এ প্রত্যাশা আরও অনেক জোরালো হয়েছিল, শেষতক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক বা না-ই হোক। সেদিক থেকে দেখলে, বিশ শতকের শেষে ধর্মের রমরমা বেড়ে ওঠা এবং মৌলবাদের উত্থান প্রায় এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান যাঁদের হাতে গড়া সেই ম্যাক্স ওয়েবার, এমিল দুর্খাইম, কার্ল মার্ক্স ও তাঁদের মত চিন্তাবিদেরা কেউই ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি, শতকে ধর্মোন্মত্ত কিছু ব্যক্তি সংগঠিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন আধুনিক রাষ্ট্র থেকে খামচে নিয়ে একটা গোটা ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলবে, বা আমেরিকার মত ভয়ঙ্কর শক্তিশালী দেশের মূল বাণিজ্যকেন্দ্র ও সামরিক দপ্তরে বিমানহানা চালাবে, বা ভারতবর্ষের মত একটি বিরাট ও প্রচণ্ড জনবহুল দেশ আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার ষাট বছর পরেও প্রবল জনসমর্থন আদায় করে তাকেq         ` ধর্মীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার কাজ প্রবল উদ্যমে শুরু করে দেবে। এর প্রতিক্রিয়ায় আধুনিকমনস্ক মানবাধিকার-সচেতন গণতান্ত্রিক যুক্তিবাদী মানুষেরা আতঙ্কিত, সেক্যুলার চিন্তাবিদেরা হতাশ ও বিমূঢ়। এবং, ধর্মমনস্ক পণ্ডিতেরা উল্লসিত

এই প্রেক্ষিতে অনেকেই বুঝতে চান, ঠিক কী ঘটছে তবে? কেনই বা ঘটছে, কোন প্রক্রিয়ায় ঘটছে? পৃথিবী কি সত্যিই তবে পেছন দিকে ঘুরছে, এবং আমরা ফেরত যাচ্ছি প্রাগাধুনিকতার দিনগুলিতে? তা কি আদৌ আর সম্ভব? এই পশ্চাদগমন যদি সত্যি হয়, তো তাকে কি প্রতিরোধ করা সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তো ঠিক কীভাবে? আর, যদি সম্ভব না হয়, তো তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎটা কী? সমাজতত্ত্ববিদেরা আজ তাই মৌলবাদ বিষয়ক চর্চায় মন দিয়েছেন, এই জরুরি প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার জন্য।

এ বিষয়টির মধ্যে আরও একটি ফ্যাঁকড়া আছে। অনেকে মনে করেন, এই ‘মৌলবাদ’ সংক্রান্ত সমস্যাটা আসলে শুধুই ইসলামের সমস্যা, আর কারুরই নয় — ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি আর মারদাঙ্গা মূলত মুসলমানেরাই করছে। অন্যদের যদি আদৌ কিছু সমস্যা থেকেও থাকে, তো সেটা শুধু ইসলামি জঙ্গিপনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। কাজেই, ইসলামীয় জঙ্গিপনাকে সজোরে দমন করলেই বাকিটা আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে। লক্ষণীয়, যাঁরা এ রকম মনে করেন, তাঁদের মধ্যেও কিন্তু অনেক মুসলমান আছেন — অত্যন্ত শিক্ষিত ও আধুনিকমনস্ক মুসলমান। আবার, এ অবস্থানটি অন্য অনেকের দুশ্চিন্তারও কারণ, ইসলামি জঙ্গিপনার বিপদ স্বীকার করেও যাঁরা মনে করেন যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নির্দোষ ও নিরীহ আম মুসলমানের ঢালাও খলনায়কীকরণ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা বিদ্বেষ ও হিংস্রতা।

এখন, এই সব কিছুর সামনে দাঁড়িয়েই আমাদেরকে বিষয়টি নিয়ে চর্চা করতে হবে, গভীরভাবে ভাবতে হবে যুক্তি সহকারে, এবং পৌঁছতে হবে কোনও এক বুদ্ধিগ্রাহ্য উপলব্ধিতে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সমকালীন সমাজবিজ্ঞান এ নিয়ে কী ভাবছে। হবেই, তার কারণ, তা না হলে আমাদের যা কিছু ধারণাগত ও আদর্শগত অর্জন — বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি, যুক্তিবাদিতা, ধর্ম জাতপাত লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের মৌল অধিকার, প্রশ্ন করার ও মতপ্রকাশের অধিকার, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, আধুনিক শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি — সব কিছুই এসে দাঁড়াবে বিলুপ্তির মুখোমুখি। এবং, এই ধারণাগত ও আদর্শগত অর্জন যদি বিলুপ্ত হয়, তাহলে আধুনিক প্রযুক্তি এবং গণতান্ত্রিক ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান জাতীয় বস্তুগত অর্জনগুলোও আর অক্ষত থাকার কথা নয়। চর্চা ও চিন্তা অপরিহার্য, অতএব। এবং, যা অপরিহার্য তা তো চলবেই, চলছেও।

ইংরিজিতে আজ যা ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে, এবং সমকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য হচ্ছে, সেই আধুনিক মৌলবাদ সম্পর্কে যুক্তিবাদী সমিতির ভেতরে বেশ কয়েক দিন ধরে কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠচক্র চালিয়ে আমরা কিছু মৌল উপলব্ধিতে এসে পৌঁছেছিলাম, এবং সেটা পুস্তিকা আকারে প্রকাশ হবার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নানা কারণেই তা এখনও করে ওঠা যায়নি, কাজ চলছে যদিও। ইতিমধ্যে মৌলবাদ বিষয়ে আমার উপলব্ধি একটু ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করছি। বলা বাহুল্য, পূর্বোক্ত ওই পাঠচক্রে আমার অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা আমার উপলব্ধিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বলা বাহুল্য বোধহয় এইটাও যে, এ আলোচনা শুরু হওয়া উচিত

 

‘মৌলবাদ’ শব্দটির অর্থ
প্রথমেই খেয়াল করা দরকার, শব্দটি কিন্তু আমরা আমাদের কথাবার্তায় প্রায়শই ব্যবহার করি, এবং সব সময়ে ঠিক একই অর্থে নয়। এবং, এই ব্যবহারিক বিভিন্নতার ছাপ পড়েছে অভিধানেও। ইংরিজি অভিধানগুলোতে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ কথাটার মূল অর্থ করা হয়েছে, ‘চিরাচরিত ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যা মেনে চলা, এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্বাস, রীতিনীতি, বাধানিষেধ ইত্যাদি কঠোরভাবে আঁকড়ে থাকা’ — বা ওই ধরনের কিছু। এবং, মৌলবাদীরা নিজেরাও তাঁদের অবস্থানের বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঠিক ওই দাবিটাই করে থাকেন — তাঁরা কোনও এক বিশুদ্ধ ‘ফান্ডামেন্টাল’ বা মূল-কে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান, অধার্মিক এই আধুনিক পৃথিবীর কুপ্ররোচনা ও কুপ্রলোভনে পা দিয়ে নিজেকে কলুষিত হতে দিতে চান না,বরং সম্ভব হলে দুনিয়াটাকেই ‘বিশুদ্ধ’ করে তুলতে চান (এটা বোঝা যায় যে, প্রবল সংরক্ষণশীলতা এর অপরিহার্য উপাদান, কিন্তু ‘মৌলবাদ’ মানে নিছক সংরক্ষণশীলতার বাড়াবাড়িটুকু মাত্র নয়)। কোনও কোনও অভিধান আবার এই বিষয়টিকে মূলত প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের ব্যাপার বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। বস্তুত, আমেরিকায় বিশ শতকের গোড়ায় একটি কট্টরপন্থী প্রোটেস্টান্ট গোষ্ঠীই কয়েকটি পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রথম এই দাবিটি  তোলে, এবং এই ধরনের অর্থে ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ শব্দটির ব্যবহারের সূচনা করে। তার পরে কিছুকাল পর্যন্ত ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’ বা ‘মৌলবাদী’ বলতে শুধু তাদেরকেই বোঝাতো। কিন্তু বিশ শতক একটু গড়াতেই বোঝা যায়, প্রায় সমস্ত প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যেই ওই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এবং শব্দটি আরও ব্যাপক ও ‘জেনেরিক’ অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। অর্থাৎ, সব ধর্মের কট্টরপন্থী জঙ্গিদেরকেই ‘মৌলবাদী’ বলে বোঝানো হতে থাকে। আবার, সাম্প্রতিক কালে ইসলামীয় জঙ্গিদের তরফে নাশকতামূলক কাজকর্ম অনেক বেড়ে যাওয়ায় কেউ কেউ ‘মৌলবাদ’ ব্যাপারটাকে শুধু ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত করে ভাবতে চান, যদিও সেটা স্পষ্টতই ভুল (পরে আবার এ প্রসঙ্গে ফেরা যাবে)।

এবং কেনই বা হবেনা, সেটাও এখানে একবার বলে নেওয়া জরুরি। কারণ, তা না হলে বিভ্রান্তি ঘটতে পারে। আসলে, আমি চাইছিলাম ‘মৌলবাদ’ কথাটার ‘ফোক’ বা জনপ্রিয়  (এবং সেইহেতু ঢিলে) অর্থের সঙ্গে তার পারিভাষিক (এবং সেইহেতু ‘রিগোরস’ বা পরিশ্রমসাধ্যভাবে নির্মিত) অর্থের তফাতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, এবং সেইসূত্রে মৌলবাদ সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। যথা — (১) মৌলবাদী উত্থানের বিভিন্ন দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে কোনও সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে কিনা, (২) একটি নির্দিষ্ট সময়কালে বিভিন্ন দেশ-জাতি-ধর্মের মধ্যে মৌলবাদী প্রবণতার উদ্ভব ও বিকাশের কোনও সাধারণ কারণ থাকতে পারে কিনা, (৩) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উন্নতির পরেও, এবং মানবাধিকার-ধর্মনিরপেক্ষতা-গণতন্ত্রের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পরেও, মৌলবাদের এই বিস্ময়কর উত্থানের পেছনে কোনও অনিবার্য কারণ ছিল কিনা, (৪) মৌলবাদ আসলে আধুনিক পৃথিবীতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার জন্য ধর্মের তরফে শেষ চেষ্টা কিনা, (৫) একটি সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে ধর্মের আজ এ ছাড়া আদৌ কোনও ‘অপশন’ আছে কিনা, (৬) আধুনিক অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে মৌলবাদের জটিল সম্পর্কের টানাপোড়েনগুলোর কাঠামো ও প্রক্রিয়াগুলো ঠিক কী ধরনের, (৭) মৌলবাদ আদৌ ধর্মের বিলুপ্তি বিলম্বিত করতে পারবে অথবা আসলে তাকে ত্বরান্বিত করবে মাত্র। এইসব আর কি!   মৌলবাদ’ শব্দটির কোন কোন সম্ভাব্য অর্থকে এড়িয়ে চলতে চাই, তার তালিকা এবার পেশ করা যাক তবে। বলা বাহুল্য, ‘মৌলবাদ’ জিনিসটা আসলে কী বলে তবে আমার নিজের মনে হয়, তার ইঙ্গিত এখানে মাঝে মাঝেই চলে আসবে হয়ত বা, কোনও সচেতন আবাহন ছাড়াই ‘মৌলবাদ’ মানে নিছক মতান্ধতা বা গোঁড়ামি বা গা-জোয়ারি নয়, এ হল আধুনিক পৃথিবীতে ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলতে থাকা ধর্মের তরফে জমি ফিরে পাবার জন্য এক মরিয়া লড়াই, হয়ত বা শেষ লড়াই।  ফলত, ‘রাজনৈতিক মৌলবাদ’, ‘বৈজ্ঞানিক মৌলবাদ’, ‘সেক্যুলার মৌলবাদ’, ‘নাস্তিক মৌলবাদ’ — ইত্যাদি কথার মধ্যে ‘মৌলবাদ’ শব্দটির প্রয়োগ নেহাতই ঢিলে প্রয়োগ, এবং বস্তুত অপপ্রয়োগ। এতে মৌলবাদের স্বরূপ প্রকাশ পায়না, বরং আরও চাপা পড়ে। বলা দরকার, সাধারণত ধর্মের হত্তাকত্তা আর উত্তর আধুনিকেরা এইসব লব্জ প্রয়োগ করে থাকেন। এবং, শব্দটির প্রয়োগ হয়ে থাকে ভিন্ন মতাবলম্বীকে গালি দেবার

‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বা ‘মৌলবাদ’ শব্দটি অনেক সময় ভুল করে ‘ডগম্যাটিজম’ বা ‘গোঁড়ামি’-র সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই ভুল অর্থে যুক্তিবাদী মুক্তমনা নাস্তিকরাও ‘মৌলবাদী’ (অর্থাৎ গোঁড়া বা মতান্ধ) হতেই পারে, অন্য অনেকের মতই। কারণ, কোনও মানুষই নিখুঁত নয়, আর নাস্তিক তো একজন মানুষই। গোঁড়ামি ছাড়িয়ে সত্যিকারের মুক্তমনস্ক হয়ে ওঠা এক দীর্ঘ ও কষ্টকর প্রক্রিয়া। কাজেই, কোনও এক বিশেষ মুহূর্তে কোনও একজন বিশেষ নাস্তিকের ক্ষেত্রে সে প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না-ই হতে পারে — হয়ত আমাদের অনেকেরই হয়রানি।