Emdadul Mia

হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ, হেরে যাওয়া সংস্কৃতি।

বিজয়ের পরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরাজয় ঘটেছে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। অর্ধ শতাব্দীর বহুবিধ অর্জনের মধ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে বিপুল বিসর্জন ঘটেছে, যে সুশ্রী ও সৌকর্যের অপচয় ঘটেছে তা আজকের বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ অচেনা করে তুলেছে। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে হাজার বছরের বাঙালিত্বকে, তার আত্মপরিচয় বিনির্মাণের ধারাবাহিকতা চোখে পড়ে না, বরং তার ওপর আরোপিত এক অদ্ভুতুড়ে বাংলাদেশ, যে কি না সর্বক্ষণ রেগে থাকে, দাঁত নখর বের করে রাখে, অন্যকে আক্রমণ করার জন্য শানিয়ে রাখে গোপন অস্ত্র। সম্প্রীতির বহুবচনতা তার কাছে মূল্যহীন, ধর্ম অবমাননা নামীয় এক অপ ও কূটকৌশলের প্রয়োগে সে দিনকে দিন অতীব-পারঙ্গম হয়ে উঠছে। অর্বাচীন কারণে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বসত বাড়ি, ভয়ের কারুকাজ বিনির্মাণে দিন দিন হয়ে উঠছে কুশলী।এই বাংলাদেশ আমার অচেনা।

আগে বাংলাদেশ বহু মানুষের দেশ ছিল; বহু রকম মানুষের প্রাণের কাছে ছিল স্বাধীন সার্বভৌম একটি মমতাময় দেশ। সে দেশটা বহু ধর্মের, অথবা একই ধর্মের বহুধা বিভক্ত গোত্রের, বহু মতবাদ ও মতাদর্শের অনুসারী মানুষকে আশ্রয় দিত, সুন্নি, শিয়া, আহমদিয়াকে যেমন আশ্রয় দিত, তেমনি আশ্রয় দিত শাক্ত বৈষ্ণব বাউলদেরকে। বৃহৎ বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে সংখ্যার বিচার দিয়ে মূল্যবান বা ঊনমূল্য করে তুলত না। সে দেশে মুক্ত চিন্তাকে বাংলা একাডেমি থেকে ফেরার পথে গলায় ছুড়ি বসিয়ে বা দা’য়ে কুপিয়ে খতম করে দেবার চল ছিল না; ভিন্নমতের সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে দ্বিমত পোষণ করারও রেওয়াজ ছিল। ধর্ম তাদেরকে কুঠুরিবদ্ধ করে অন্যকে আঘাতের জন্য অস্ত্রে শান দিতে শেখাতো না। কাউকে কুঠারাঘাত করে ফিরে এলে সাদরে বরণ করার রীতি ছিল না, অথবা মৃত্যুদাতা হতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পড়লে সরাসরি বেহেশতে পৌঁছে হুরীদের সঙ্গে আদর-সোহাগে জীবন কাটাতে পারবে, এমন নিশ্চিত সংবাদ প্রচারের রীতিও ছিল না। দেশের অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তাকে যেমন সমাদর করতো, তেমনি ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, নিজেকে ও দেশকে এগিয়ে নেবার শপথে অবিচল থাকত। বহুজনের আত্মত্যাগে, বহুমানুষের জ্ঞানে প্রজ্ঞায়, অবদানে গড়ে ওঠা চিরচেনা সর্বজনের বাংলাদেশের সঙ্গে ধর্মনির্বিশেষে সকলের আত্মিক সম্পর্ক ঠিক সেভাবেই গড়ে উঠেছিল।

যতটা আগের বাংলাদেশের কথা আমি বলছি, তা আদ্যিকালের কোন দেশ নয়; গুপ্ত, মৌর্য, পাল বা মোগল আমলের বাংলাদেশও নয়। আগে মানে পঞ্চাশ বছর আগের বাংলাদেশের কথাই বলা যাক, যখন বাংলাদেশ বহুজনের ভালবাসার সংযুক্তি ও মুক্তিতে অনন্য ছিল। বুকে বুলেট গেঁথে দেশ স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য ধর্ম কারো সামনে বাধা হয়ে ওঠেনি। কাঁধে রাইফেল তুলে নিতে নিতে মুক্তিযোদ্ধারা একবারও ভাবেনি তার সহযোদ্ধাটি কোন ধর্মের অনুসারী। মুক্তিঅর্জন প্রক্রিয়ার দুঃসহ দিনগুলোতে দিনের পর দিন অনাহারে কাটালেও অন্যের কথাই তারা আগে ভেবেছে, কাউকে নিরন্ন রেখে নিজের উদরপূর্তি করেনি; যুদ্ধের মাঠে সহযোদ্ধাকে ছেড়ে পালিয়ে আসার কথা ভাবেনি; নিজের আখের গোছানোর কথা তাদের চিন্তার মধ্যেই ছিল না। একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর, সামগ্রিক বা বহুতর কল্যাণ চিন্তা ছিল তাদের মৌলবাসনা। যুদ্ধের মাঠে যেমন, যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে, অন্তত কয়েকটা বছর, একবারও কারো মনে হয় নি তার প্রতিবেশির নাম কি সুধীর, রিচার্ড বা অন্তু লারমা, মনে হয় নি এরা তার ভাই নয়, অথবা সরলা, এলিজাবেথ তার বোন কিংবা মা নয়।

পঞ্চাশ বছর তো অবশ্যই, তিরিশ বছর আগেও সেই বহুজন, বহুসংস্কৃতি, বহু ধর্মের বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যেত; যদিও তার বিচিত্র বর্ণিল রঙ নানা রাজনৈতিক কূটচালে ততদিনে ফিকে হতে শুরু করেছে; অনেক রঙের বিভার বদলে কেবল একটা রঙের দিকে ধাবিত হতে হবে বলে পেছন থেকে এক বা একাধিকজন চোখ রাঙাতে শুরু করেছে। সেই দৃশ্যমান ও অদৃশ্য চোখ রাঙানি নিরন্তর ফিসফিস করে বলে চলেছে, দেশটা কেবল মুসলমানের, অন্যেরা এখানে সংখ্যালঘু; তারা সংখ্যাগুরুর দাক্ষিণ্যে বাস করবে, ইচ্ছে হলে সংখ্যাগুরু ধার্মিকপ্রবরেরা সংখ্যালঘুকে তাড়িয়ে দিতে পারবে, জেলে ভরতে পারবে, জমির দখল নিতে পারবে, মন্দির জ্বালিয়ে দিতে পারবে, প্রতিমার মাথা বা হাত ভেঙে ফেলতে পারবে, কুকুর লেলিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিতে পারবে। অথচ সে সব ঘৃণ্য অপরাধের কোন পরিণাম কাউকে ভোগ করতে হবে না। রাষ্ট্র তাকে ক্ষমা করবে, সমাজ তাকে ক্ষমা করবে, অন্য মহামতি মুসলমানেরা সাবাস সাবাস বলে বাহবা দেবে; বলবে, এটাই তো হওয়া উচিত; মুসলমানের দেশে থাকবে আবার মূর্তি পূজা করবে, মঙ্গল শোভাযাত্রা করবে, শহীদ মিনারে ফুল দেবে, আর জাতীয় সঙ্গীতের নামে শিরক করবে, কত্তবড় সাহস? এই সব ‘অমুসলমান’দেরকে পুড়িয়ে মারা, পায়ে দলে পিষে মারা, কুপিয়ে রক্তাক্ত করা, পায়ের রগ কেটে পঙ্গুত্ব উপহার দেয়া, মুরতাদ ঘোষণা করে আক্রমণ করা সবই সাচ্চা-মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। সে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারলে নিশ্চিত বেহেশত। তেমন মৃত্যুর পর শহীদী দরজা পেরুলেই সে দেখতে পাবে বেহেশতে শত হুর তার জন্য অপেক্ষমান, যাদের শরীর এতটাই স্বচ্ছ যে তাকালে তাদের হাড়ের মজ্জা অব্দি দেখা যায়। সেই অতীব সুন্দরী হুরীদের নৃত্যগীতে বেহেশত মুখরিত, তাদের সৌন্দর্যে বেহেশত উজ্জ্বলিত। মুরতাদকে খুন করতে পারলে, হাতে রক্ত মেখে ঈমানি দায়িত্ব পালন করতে পারলে সেই সৌন্দর্যের, ভোগের আর প্রাপ্তির ভেতর অনন্তকাল বাস করতে পারবে।

অমন অনন্ত জীবনের চেয়ে এই পার্থিব জীবন, দুই দিনের জীবন, চোখ বুজলেই যা শেষ, তা কি কোন অর্থেই ভাল হতে পারে? তার চেয়ে মুরতাদকে খুন করো, রগ কেটে দাও মুক্তচিন্তাকারিকে, বাড়ি জ্বালিয়ে দাও বিধর্মীদের, দরকার হলে রাতের খাবার খেতে আসা নিরপরাধ মানুষদের ঝাঁঝরা করে রক্তমাখা হাতে পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে সিজদা করো, জগতকে জানিয়ে দাও তোমরা হুর সমৃদ্ধ বেহেশতের কতটা কাছে দাঁড়িয়ে আছো!

তবে তিরিশ বছর আগেও ঐ সব কূপমণ্ডুকতা, জঘণ্যতম মিথ্যাচার আর ছেলেভুলানো বেহেশতের নিশ্চিত আশ্বাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উপযোগী একটা সুসংগঠিত গোষ্ঠী বাংলাদেশে সক্রিয় ছিল। তারা সকল প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রেখেছিল। সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে দিয়ে দেশের সঙ্গে, জনমানুষের সঙ্গে, মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গে, কৃষকের, শ্রমিকের, মুটে-মজুরের, ছাত্র-যুবার সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিল। পুরোপুরি সমর্থ না হলেও শুধু যে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার ধারাবাহিকতাই তারা অব্যাহত রেখেছিল তা নয়, পরন্তু তারা সারা দেশে সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের বাতারণ তৈরি করতে পেরেছিল। তাদের চেষ্টায় তখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতকে হিন্দুয়ানি গান বলে কেউ কটাক্ষ করতে পারত না; নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতকে নজরুলের লেখা নয় বলে দাবী করে, নজরুলের ছবিতে টুপি পরিয়ে সাচ্চা মুসলমান বানানোর চেষ্টা তখনও শুরু হয়নি। সাংস্কৃতিকর্মীদের অবিরাম প্রচেষ্টায় খানিকটা হলেও, চোখ মেলে তাকালেই বহুবৈচিত্র্যের বর্ণিল বাংলাদেশের দেখা মিলত। সেখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা তাদের স্বতন্ত্র ধর্মের বিভাজনে আলাদা হলেও সুহৃদ হয়ে পাশাপাশি থাকা বা পরস্পরের উৎসবে যোগ দিতে সঙ্কুচিত হতো না। অসঙ্কুচিত চিত্তে, উদারতার বৈভবসমৃদ্ধ মানুষেরা বিশ্বাস করতো, ধর্মে স্বতন্ত্র হলেও বাঙালি হিসেবে তারা যূথবদ্ধ; ধর্ম তাদের ঘরের বিষয়, ব্যক্তিগত বিশ্বাস, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিগত ধর্মচর্চা বা বিশ্বাসের যোগ যত কম ঘটে ততই মঙ্গল; বৃহত্তর জনমানসের সঙ্গে যুক্ত হতে পারাই প্রকৃত মানবিক ধর্ম।

তখনও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের লড়াই বাধিয়ে, ধর্মীয় ঝাণ্ডা পতপত করে আকাশে উড়িয়ে বুকের ভেতর ঈমানি জোশ অনুভব করার মত মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল; বরং এর উল্টোযাত্রায় বিশ্বাসীরাই ছিল সংখ্যাগুরু। তাদের বিশ্বাস ছিল ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ নেই, সংস্কৃতি এক দেশজ প্রণোদনা, তাকে বাদ দিয়ে শুধু ধর্মের দিক মুখ করে থাকলে চিন্তার জগতে বাস্তুচ্যুত হতে হয়। কারণ কেন্দ্র থেকে ধর্ম যতই দূরবর্তী হতে থাকে দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে তার মিশেল ঘটে বেশি; সেই মিশেলে ধর্ম বা সংস্কৃতি কারোরই ক্ষতি হয় না বরং বৃদ্ধি ঘটে, ধর্ম আর সংস্কৃতি গড়ে তোলে এক নতুন সমাজ, যার মৌল চরিত্র সহনশীলতা ও সম্প্রীতিতে মুখরিত। তাই দেশজ সংস্কৃতিকে বর্জন না করে যে-ধর্ম সমাজের ও সংস্কৃতির ভেতর গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পায়, সে ধর্মই মানুষের ভেতর কালান্তরে বেঁচে থাকে। সে কারণেই বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রীতি মেনে বিয়েতে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানাদিতে দেশজ আচার পালন করার মধ্যে কেউ অধার্মিকতা খুঁজে পেত না; বধূ বরণে বহু যুগের স্ত্রী আচারকে বেদাত বলে ভ্রূকূটি করতো না কেউ, বরং তা পারিবারিক আনন্দকে আরো বেশি উজ্জ্বল ও উচ্ছ্বল করে তুলত। শবে বরাতের রাতে হালুয়া রুটি খাওয়া, বা পড়শিদেরকে তার ভাগ দেয়াকে বেদাত মনে করত না, রাত জেগে নামাজ পড়া, বা মৃত আত্মীয়ের কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁদের স্মরণ করাকে বেদাত মনে করতো না; নামাজের পর মোনাজাত করা, বা মোল্লা বা ইমাম ডেকে মিলাদ পড়ানোকেও ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করত না কেউ। তখনও বাংলাদেশে রমজান মাস ‘মাহে রামাদান’ হয়ে যায়নি; নামাজ ‘সালাত’ হয়ে যায়নি, সেহরি হয়ে যায়নি সাহরি বা সুহুর, খোদা হাফেজ হয়ে যায়নি আল্লাহ হাফিজ। তখনও কেউ ‘ধর্ম যার যার উৎসব তার তার’ বলার মত অর্বাচীন হবার দুঃসাহসও দেখাতো না, বরং বুক ফুলিয়ে বলতে ও অন্তরে অনড়ভাবে বিশ্বাস করতে দ্বিধা হতো না যে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’।

এখন আর সেই বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

এখন যে বাংলাদেশে মানুষ বাস করে, তার সঙ্গে হাজার বছরের বাংলার সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া দুরূহ; মনে হয় এ এক নতুন বাংলাদেশে, মনে হয় এ দেশটি ধার করে আনা হয়েছে অন্য কোন অন্ধকারময় ‘স্থান’ থেকে। অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তের দামে কেনা দেশের ওপর দ্রুত গতিতে কালো থাবা বিস্তার করছে। এ এক অচেনা বাংলাদেশে। এ দেশ থেকে মুক্ত চিন্তার, সকল ধর্মের ও সকল শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতি হারিয়ে যাচ্ছে। চির চেনা সবুজ-শ্যামল দেশটি সবার চোখের সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে অথবা হারিয়ে গেছে। সবাই তাকিয়ে দেখেছে নিজেদের পরাজয়, কেউ বাধা দিচ্ছে না। অথবা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে সম্মানের সঙ্গে তার যোগ্য আসনে বসানোর চেষ্টাও করছে না। রাষ্ট্র সে চেষ্টা করে নি, করছেও না। রাজনৈতিক দল সে চেষ্টা করে নি এবং ভবিষ্যতে যে তেমন চেষ্টা করবে তারও কোন নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে বরং এমনও দেখা গেছে অথবা যাচ্ছে, ক্ষমতায় টিকে থাকার অভিপ্রায়ে সরকার ছাড় দিয়েছে অপশক্তির কাছে, নিজেদেরকে নামিয়ে নিয়েছে অপশক্তির কাতারে; নিজেদের রাজনীতিক স্বাতন্ত্র্য ও সর্বজনীনতাকে বিকিয়ে আপস করেছে এবং করছে। ক্ষমতালিপ্সায় তারা নামতে নামতে এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, যেখানে রাজনীতিক আদর্শ, দলগত স্বাতন্ত্র্য ও বহুমানুষের কল্যাণ ভাবনা নয় বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনায় আপসকেই তারা মনে করছে একমাত্র নিদান।

ছাড় দেওয়া বা আপসের রাজনীতি আসলে ক্ষমতায় পাকাপোক্তভাবে থাকবার একটা আপকৌশল; সেই কৌশল-প্রয়োগের কারণেই হাজার বছরের চেনা বাংলাদেশকে যে কখন টেনে নামাতে নামাতে অচেনা করে তুলেছে, তা তারা বুঝতেও পারে নি; অথবা বুঝতে পারলেও চোখ বুজে থেকেছে। কারণ ক্ষমতার উষ্ণতা মানুষকে দূরদৃষ্টি দেয় না, বরং যতদিন ক্ষমতায় থাকা যায় সে চেষ্টার মধ্যেই চতুরতার পরাকাষ্ঠা দেখায়। তারা বুঝতে পারে নি, অথবা বুঝতে পারলেও, যেমনটা একটু আগেই বললাম, ক্ষমতায় থাকা যাবে বলে ছাড় দিয়েছে। আর সেই ছাড়ের সুযোগেই চতুর-সারথিরা বাঙালি সংস্কৃতির কপালে অমোঘ ও অব্যর্থভাবে লিখে দিয়েছে হেরে যাবার ও হারিয়ে যাবার ইতিহাস। দেশের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতেই পারেনি, অথবা বুঝতে পারলেও রাজনীতির নানাবিধ জটিল সমীকরণের কারণে বাঙালি সংস্কৃতির পরাজয়কে মেনে নিয়েছে। হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তস্বাধীন বাংলাদেশ হারিয়ে গিয়ে যে বাংলাদেশ আজ আমাদের সামনে দৃশ্যমান, তাকে তো আর স্বাধীন, মানবিক, সম্প্রীতির ও বহুজনের বাংলাদেশ বলে চেনাই যায় না, বরং তাকে খুব সহজেই রক্তমুখো, অসহিষ্ণু, আসুরিক শক্তি লালনকারি ‘বাংলাস্তান’ বলে মনে হয়।