সব ধর্মই মানুষকে শান্তির দীক্ষা দেয়, শান্তির কথা বলে। কিন্তু মানুষ ধীরে ধীরে ধর্মের এসব বাণীর পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতাকে জীবনে আঁকড়ে ধরে। বিশেষভাবে যারা কেবল ধর্মশিক্ষা করে, তারা আধুনিক, মানবিক, সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার স্পর্শ পায় না।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানপন্থিদের অপপ্রচার জনমানসকে বিপুলভাবে বিভ্রান্ত করে, এখনও করছে। এরশাদ এসে ১৯৮৮ সালে আরেক ধাপ এগিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন, যা আজও চলছে। এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয়। ইংল্যান্ডে এখনও এংলিগান্ট চার্চের প্রধান রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয়, কিন্তু সেটা নিয়ে সেখানে কেউ মাথা ঘামায় না, জানেও না।
বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থের কথা আমরা সবাই জানি। কুসংস্কার থেকে মুক্তির জন্য বিদ্যাসাগর আন্দোলন করেছেন, রাজা রামমোহন রায় আন্দোলন করেছেন। বেগম রোকেয়া, বিদ্যাসাগর বা রামমোহনের যে আন্দোলন এগুলো কিন্তু মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার আন্দোলন ছিল। বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনও ছিল মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার আন্দোলন।
ফরাসি বিপ্লবের আগে সেখানে চার্চকে বলা হতো ফার্স্ট এস্টেট, সামন্ততন্ত্রকে বলা হতো সেকেন্ড এস্টেট। সাধারণ জনগণ ছিল থার্ড এস্টেট। বিপ্লব এসবকে উচ্ছেদ করে, ফার্স্ট ও সেকেন্ড এস্টেটের অধিকার খর্ব করে, জনগণকে সমান নাগরিক অধিকার প্রদান করে। ১৭৮৯ সালে আমেরিকার সংবিধান (যা আধুনিককালের প্রথম সংবিধান) রচিত হয়। এই সংবিধানে পরিস্কারভাবে বলা হয় যে, রাষ্ট্র কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখাবে না, চর্চায়ও বাধা দেবে না। এভাবেই আমেরিকা আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার প্রথম পদক্ষেপ নেয়।
আমরা জানি যে ব্রিটিশরা আসার পরে তারা এ দেশকে শোষণ করেছে। তারা আসার আগে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একটি ধনী দেশ ছিল। যদিও বাংলাদেশ শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশে পরিণত হচ্ছিল। ব্রিটিশদের কারণে আমরা সেসব কুসংস্কার থেকে মুক্তি পেয়েছি। আবারও বলছি ব্রিটিশরা যদিও আমাদের শোষণ করেছে, তারপরও তাদের সংস্পর্শে এসে আমরা একটা আধুনিক জগতের সন্ধান পেয়েছিলাম। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতক থেকে, বলা যায় যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ দিক থেকে আমাদের এই উপমহাদেশ পিছিয়ে পড়েছে-এই নিয়ে অনেক গবেষণা আছে, এসব গবেষণায় আমরা দেখি যে, কীভাবে মানুষ ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়েছে, ব্রিটিশরা আসার অনেক আগেই হিন্দু সমাজে বর্ণপ্রথার প্রচলন হয়েছে, মুসলমান সমাজে আশরাফ-আতরাফ শ্রেণিবিভাগ হয়েছে। আমরা দেখি যে মুসলিম নারীদের পর্দাপ্রথার নামে কীভাবে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, হিন্দু নারীদের কীভাবে সতীদাহ প্রথার নামে আগুনে বলি দেওয়া হয়েছে। এই সতীদাহ থেকে ব্রিটিশরা হিন্দু নারীদের মুক্তি দিয়েছে, বেগম রোকেয়ার সংগ্রামের কারণে মুসলমান নারীরা অন্ধকার থেকে আলোয় আসার পথ খুঁজে পেয়েছে।
ইউরোপে একসময় ধর্ম নিয়ে বিশাল হানাহানি হয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিষ্টানদের যে দ্বন্দ্ব সে কথা বাদই দিলাম, জেরুজালেমকে মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য একে একে চারটি ক্রুসেড সংঘটিত হলো, আবার ইউরোপীয়রা ধর্মীয় উন্মাদনায় নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টানরা দীর্ঘদিন ধরে ধর্মযুদ্ধ করেছে। এমনকি একে অন্যের অনুসারীদের পুড়িয়ে মেরেছে, নির্মমভাবে হত্যা করেছে। প্রচলিত ধর্মচিন্তার বিরুদ্ধে গেছে বলে বিজ্ঞানী ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, গ্যালিলিওর বিচার করেছে চার্চ, বলেছে তার বক্তব্য বাইবেলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। ইউরোপে মধ্যযুগে ধর্মীয় উন্মাদনায় বহু নারীকেও ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অসংখ্য সংঘাতের মধ্যে গিয়ে তারা উপলব্ধি করেছে ধর্মীয় উন্মাদনা সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনকে বিপন্ন করে, জীবনের সব ধরনের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেয়। তাই আজ পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানচিন্তা এগিয়ে গিয়ে ওই অঞ্চলের প্রায় সব রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
ইউরোপসহ পৃথিবীর অনেক দেশে একসময় ব্লাসফেমি আইন ছিল। এমনকি ভারতের হিন্দু সমাজেও ছিল। মনুসংহিতায় ব্রাহ্মণ আর শূদ্রের অপরাধের বিচার আলাদাভাবে হতো। যেমন একটি অপরাধে শূদ্রের যে শাস্তি হবে, একই অপরাধে ব্রাহ্মণের শাস্তি কিন্তু অনেক কম হতো। এই যে বৈষম্য, সেটাই যদি রাষ্ট্রের ভিত্তি হয় তাহলে সেই রাষ্ট্রে তো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থাকবেই।
বাংলাদেশকে আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আইনের সংস্কার করতে হবে, ধর্মীয় শিক্ষাকে আধুনিক ও মানবিক করতে হবে। আমি মনে করি কুমিল্লায় যে ঘটনা হয়েছে সেটা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। তবে ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। আজ ইউপি নির্বাচন নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ অনেক বেশি ব্যস্ত। দলীয় ব্যানারে স্থানীয় নির্বাচন সংঘাত-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। দলকে কিন্তু আদর্শের পথে নিয়ে যেতে হবে, সংঘাতমুক্ত করতে হবে, দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
‘৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একসাগর রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই যেটা করেছিলেন সেটা হলো তিনি একটা রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করেছিলেন। পাকিস্তান আমলের ৯ বছরেও শাসকরা একটা সংবিধান দিতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই একটি অসাধারণ সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যে সংবিধান তিনি বাঙালি জাতিকে দিয়েছিলেন সেখানে বঙ্গবন্ধু কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, চারটি স্তম্ভের ওপরে আমাদের সংবিধান প্রতিষ্ঠিত করা হলো। এবং তিনি এও বলেছিলেন, এই সংবিধান বাঙালির ইতিহাসের প্রথম সংবিধান। বাঙালি জাতিসত্তার যে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস, আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশই সেই ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন দেশ। এর আগে যেসব রাষ্ট্র ছিল সেগুলো বিভিন্ন রাজা-বাদশা-নবাবের রাজত্বের রাষ্ট্র্র ছিল, জনগণের রাষ্ট্র ছিল না। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ (এই রাষ্ট্র প্রতিটি বাঙালির নিজের রাষ্ট্র) আমাদের প্রথম রাষ্ট্র যা সৃষ্টি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ জন্যই তিনি জাতির পিতা। এই রাষ্ট্রের, বাঙালির প্রথম সংবিধানে জনগণকে তিনি সকল ক্ষমতার উৎস হিসেবে ঘোষণা করেন। সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি করা হয়েছিল সেগুলো ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটা হতে দেননি। যেমন ভাসানী সাহেব কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, মানবিক নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার পত্রিকা ‘হক কথা’য় ধর্মান্ধতার ব্যাপক প্রচার হতো, বঙ্গবন্ধু সরকারকে হিন্দু ও ভারতের ক্রীড়নক হিসেবে দেখা হতো। অথচ বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীকে বলে ভারতীয় সৈন্যকে প্রত্যাহার করান, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। উল্লেখ্য, এখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী আমেরিকার সৈন্য জাপানে রয়ে গেছে।
ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি ছিল দুটো, তার মধ্যে একটা হলো- সামন্ততান্ত্রিক বৈষম্য দূর করা। ফরাসি বিপ্লব একই সঙ্গে সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়ে ঘোষণা করেছিল যে, আজ থেকে এই রাষ্ট্রের সবাই সমান অধিকার পাবে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের শেষ-অবশেষও বিলোপ করে ইউরোপের সব জনগণকে সমান অধিকার দেওয়া হলো (রাশিয়ায় অবশ্য তখনও সামন্ততন্ত্র বজায় ছিল)। একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করার পরও বাংলাদেশে জামায়াত ও পাকিস্তানপন্থি অনেকেই তাদের প্রচারিত ধর্মীয় উন্মাদনা-উগ্রতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। এর কারণ হলো স্বাধীনতার পর জাতির পিতা আমাদের সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি দিয়েছিলেন সেটা আমরা রক্ষা করতে পারিনি, ‘৭৫-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার যে আদর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন সেই আদর্শকে পরে রাষ্ট্র আর লালন করেনি। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ছিল, মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই যার যার ধর্ম পালন করবে, কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না, ধর্মকে কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশ পরিচালিত করতে পারতাম, তাহলে আজকের এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দেখতে হতো না।
সাধারণত একটা বড় বিপ্লবের পরে নানা কারণে জনগণের অনেক অধিকার খর্ব করতে হয়। যেমন ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও চীনা বিপ্লবের পর রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা নিয়ন্ত্রণে সরকার অনেক বেশি কঠোর ছিল। বঙ্গবন্ধু কিন্তু তা করেননি, তিনি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেননি। তারপরও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এই দেশকে একটি সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তুলতে, তিনি চেয়েছিলেন এই দেশের মানুষ তাদের সব অধিকার পাবে, তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। সে জন্য তিনি বিশ্বের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ সংবিধান রচনা করেছিলেন, যেখানে সবাইকে সমান ধর্মীয় অধিকার দিয়েছিলেন। আজকে কিন্তু অপ্রত্যাশিত অনেক সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে। এবারের দুর্গাপূজায় কুমিল্লায় যে ঘটনাটা ঘটল, সেটা দেখে মনে হয়েছে, যে কেউ এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটিয়ে দেশে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি করতে চেয়েছে, সক্ষমও হয়েছে।
আজ দেশে যে সাম্প্রদায়িতকতার বিষবাষ্প চলছে সেটা আমাদের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যে কুঠারাঘাত করেছে। বাংলাদেশ অবশ্যই একদিন আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। বর্তমানে যেসব ঘটনা ঘটছে সেসব বিচ্ছিন্ন। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে একটি মহল পরিকল্পিত পথে এসব করছে। এই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিরোধের জন্য প্রশাসনকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের শুভবুদ্ধি আছে। সেই শুভবুদ্ধির পথে দেশকে পরিচালিত করতে হবে।