সম্প্রতিকালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে যুদ্ধ-বিবাদ লেগে আছে তা দুটো ভিন্ন কারণের উপর ভিত্তি করে; ধর্মীয় উগ্রবাদ অথবা উগ্র জাতীয়তাবাদ।
১৯৪৭-এ ভারতীয় উপমহাদেশেও বিভাজন হয়েছিল ধর্মের উপর ভিত্তি করে। বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) যে অবিচার, অসমতা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা, মারামারি, দাঙ্গাগুলো দেখা দিচ্ছে তার পিছনে রয়েছে ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা, ধর্মের অপব্যাখ্যা এবং ধর্ম নিয়ে অতিরঞ্জিত কার্যকলাপ ও উগ্র জাতীয়তাবোধ।
ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ সামাজিক শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের জন্য বাধাস্বরূপ এবং এ দুটি বিষয় বিশ্বের অনেক জায়গায় বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেকোনো উগ্রবাদ বিভাজন সৃষ্টি করে, কখনও একত্রিত করে না। এমন কোনো নজির নেই যেখানে ধর্মীয় উগ্রতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে দুটি সমাজ বা দেশ এক হয়েছে। সমাজের শান্তি ও সম্প্রীতি নির্ভর করে একটি অঞ্চলের মানুষের ইতিবাচক মানসিকতার উপর; ধর্ম বা জাতীয়তার উপর নয়।
একই ধর্মের ও গোত্রের মানুষ হলেই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারবে বিষয়টি এমন নয়। ধর্মীয় কারণে যদি আমরা এক হতে পারতাম তাহলে সৌদি আরবের সঙ্গে ইয়েমেনের যুদ্ধ হতো না, ইরান ও ইরাক এক থাকতো। ভারতীয় কাশ্মীর ও পাকিস্তানের কাশ্মীরের ধর্ম এক হলেও তারা এক নয়।
এসব উদাহরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একই ধর্মের মানুষ হলেই যে এক দেশ বা সমাজে শান্তিতে থাকবে বিষয়টি এমন নয়। উগ্রবাদ মিলের চেয়ে বিভাজনকেই বেশি প্রাধান্য দেয়।
বিশ্ব তথা সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ধর্মীয় সহনশীলতা জরুরি, উগ্রতা নয়। তাই শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আমাদের শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থা এমনভাবে গোছাতে হবে যেন কেউ ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত না করতে পারে এবং বিভাজন সৃষ্টি করতে না পারে।
একটি সমাজ দেশ ও জাতির মাঝে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার মূল বিষয়টি হল মানুষের ইতিবাচক মানসিকতা। আর এই বিষয়ে আমাদের সবারই উচিত নিজেদের পক্ষ থেকে সচেতন হওয়া। ধর্ম আসলে কী বলে সেটা আমাদের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কোনো ধর্মই সহিংসতাকে সমর্থন দেয়নি, অশান্তিকে প্রশ্রয় দেয়নি অথবা কাউকে অসমতার চোখে দেখা উচিত বলে ব্যক্ত করেনি। সব ধর্মে বলা হয়েছে শান্তি বজায় রাখতে, অসমতা দেখলে সমতা আনার জন্য কাজ করতে। কোনো ধর্মের অপব্যাখ্যা বা এর অপব্যবহার না করতে।
আমরা যদি এসব বিষয়ে নিজ নিজ স্থান থেকে সচেতন হই তাহলে আমাদের মাঝে কেউ বিভাজন সৃষ্টি করতে পারবে না। আমার ধর্মের প্রতি আমার যেমন মায়া-মমতা ও শ্রদ্ধা রয়েছে, ঠিক অন্যের ধর্মের প্রতি অনুরূপ শ্রদ্ধা থাকা উচিত। আমার ধর্মের প্রতি কোনো অবমাননা আমি যেমন কামনা করি না, ঠিক তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বীও তার ধর্মের প্রতি অবমাননা কামনা বা প্রত্যাশা করে না।
অনুরূপভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষয়েও আমাদের সচেতন থাকতে হবে। জাতীয়তাবাদ বলতে আসলে কী বোঝায় এবং এর ইতিবাচক দিকগুলো মানুষের মাঝে তুলে ধরতে হবে। এসব বিষয়ে যদি আমরা আমাদের জীবনে চলার পথে, আমাদের সব পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায়, আমাদের সাধারণ আলোচনায় নিয়ে আসতে পারি, তাহলে মানুষ বিভ্রান্ত হবে না।
একটি সুস্থ ও সুন্দর মানসিকতা সব অশান্তির অবসান ঘটাতে পারে। কাজটি অবশ্যই একদিনে সম্ভব নয়, একটা জিনিস শুরু করলেই তার শেষ হয়। তাই আমরা যত দ্রুত এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আসতে পারব আমাদের জন্য ততই কল্যাণকর হবে।
ধর্ম ও জাতীয়তাবোধের ইতিবাচক দিকগুলো প্রচার এবং প্রসার নিয়ে সাংবাদিকদেরও যথেষ্ট সচেতন হতে হবে এবং তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোতে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এসব প্রচারের কারণেও মানুষের মধ্যে ভেদাভেদের মানসিকতা অনেকটাই কমে আসবে। সহিংসতা ও অরাজকতা কমিয়ে আনবে এবং মানুষের মাঝে মিলেমিশে থাকার মনমানসিকতার সৃষ্টি করবে।
শুধু তাই নয় আমরা আমাদের বিভিন্ন আলোচনা সভা, শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসব ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে পারি।
আমাদের সবার সুচিন্তাধারা গুলো আদান-প্রদান করতে হবে, এর ফল হয়ত বা আজকেই নয়, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পর সুন্দর একটি ফলাফল আমরা দেখতে পারব। আমরা যদি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে রেখে যেতে পারি, তা তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে, তাদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করবে এবং একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। আমরা এই চিন্তা ধারা গড়ে তুলতে পারলে একটি দেশেই বিভিন্ন গোত্রের, বর্ণের, গড়নের, ধর্মের মানুষ একইসঙ্গে কোনো ভেদাভেদ ছাড়া বসবাস করতে পারবে।
এ জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত কাজ করে যেতে হবে। হয়ত ১০০ বছর পর এমন এক পৃথিবী হবে যেখানে ভ্রমণে কোনো ভিসা লাগবে না। লাগলেও হয়তো বিষয়টা খুবই সহজ হবে। আমাদের ভেতর যে প্রতিযোগিতা, অসমতা, ঘৃণা ও ভেদাভেদের জায়গাগুলো আছে সেগুলো আর থাকবে না।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হিংসা-বিদ্বেষ, অসমতা, সহিংসতা ও যুদ্ধবিহীন একটি বিশ্ব আমাদের রেখে যাওয়া প্রয়োজন, যেন তারা একটি স্থিতিশীল পরিবেশে বসবাস করতে পারে, নিজেদেরকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে।
শান্তি ও স্থিতিশীলতা যতটা না আর্থিক, ধার্মিক ও জাতীয় বিষয়; তার থেকে অনেকাংশেই এটা নির্ভর করে মানুষের মানসিকতা, চিন্তাশীলতা, সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা ইত্যাদির উপর। আমরা যদি মানসিকভাবে স্থির চিন্তার অধিকারী হই তাহলে দারিদ্র্য কোনো বিষয়ই নয়। কেবল ইতিবাচক চিন্তাশীলতার মাধ্যমেই ৯০% সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, আর বাকি ১০% অর্থনৈতিক সমস্যা আমাদের ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে সমাধান হবে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের কারণ হলো উগ্র জাতীয়তাবাদ। আর এর কারণেই ইউক্রেন রাশিয়ার উপর থেকে আস্থা হারিয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে ন্যাটোর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। অথচ এই দুটি দেশ ৭০ বছর একসঙ্গে থেকেছে। ১৯৯১ সালে বিভাজনের পর থেকেই তাদের মাঝে উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে দুটি দেশের মাঝে অস্থিরতার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে এবং একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে শুরু করে। তাদের এই উগ্র জাতীয়তাবাদ আজ এমন একটি পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এতে জান এবং মাল উভয়ের ক্ষতিসাধন হচ্ছে।
১৯৪৭-এ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজন ধর্মীয় উগ্রবাদ এর কারণে, এত বছর পরেও বিভাজিত দেশগুলোর মাঝে দূরত্ব শুধু বাড়ছেই। ঠিক তেমনি ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও রাশিয়া এবং ইউক্রেনের দূরত্ব বেড়েই চলেছে।
আমাদের মাঝে শুধু যদি এই চিন্তাধারাটি আসে- আমরা সবাই মানুষ সবার শান্তিতে বাঁচার এবং বসবাসের অধিকার রয়েছে; তাহলে এসব অস্থিতিশীলতা কমে যাবে। আর এটি যে সম্ভব এটা বাস্তব উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশ মিলেমিশে সমাজ ও দেশ পরিচালনা করছে। আমরা এমন একটি ইতিবাচক উদাহরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শান্তিপ্রিয় বিশ্ব গড়ে তোলার কাজ করতে পারি।
ধর্ম পরিচয় বা জাতীয়তার পরিচয় কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই পরিচয়ের কারণে আমরা একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হব? একে অপরের প্রতি অত্যাচার অবিচার বা হত্যা করব? আমাদের মমতা কোথায়? আমাদের মনুষ্যত্ব কোথায়? আমরা যে সবাই মানুষ এটা কি ভুলে যাচ্ছি? আমার এ প্রশ্ন সবার কাছে।