বহুদিন ধরেই একথা দেশের প্রগতিশীল সকল পক্ষ থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে উগ্রবাদ ভয়ংকর ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং এর বিস্তার ঠেকাতে কোনো সরকারই তেমন গা করছে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের এ ব্যাপারে নিরুদ্বেগ থাকাটা নিঃসন্দেহে বেদনার। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় সহিংসতা, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং সামাজিক অস্থিরতা বিগত বছরগুলোতে এতোটাই মাত্রা ছাড়িয়েছে যে, নাগরিক-মনে নিদারুণ ভয় ও ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।
এই ভয়-ভীতি দূর করে বাংলাদেশকে একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জনবান্ধব দেশে পরিণত করাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন হলো এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করবে কে? আরও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই ধর্মীয় উগ্রবাদের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ যে নেতিবাচক পরিচিতি পাচ্ছে সে বিষয়ে কি আমরা অবগত বা চিন্তিত? সমাজ, রাষ্ট্র বা পরিবার, কোনো জায়গা থেকেই এ বিষয়ে কি উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়? যায় না। এটাও বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে দিন দিন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের গৌরবও যেমন আপনার-আমার তেমনই বাংলাদেশকে ধর্মীয় উগ্রবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার নিন্দার ভাগও আপনার-আমারই।
কার উদাহরণ দিয়ে শুরু করবো? হৃদয় মণ্ডলের কথাই ধরা যাক। বিক্রমপুরের একটি বিদ্যালয়ে তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া তার বসতবাড়িটি দেখে যে কেউ বুঝবেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষেই একজন নিষ্ঠ বিজ্ঞান-সাধক। গোটা বাড়িতে পদার্থ বিদ্যার নানা সূত্র লেখা, কোথায় কোথাও দেয়ালে জটিল অঙ্ক কষা, ছবি আঁকা বিভিন্ন সমীকরণের। আমাদের মনে করিয়ে দেয় হলিউডের বিভিন্ন সিনেমার কথা, যেখানে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবন নিয়ে তৈরি সিনেমায় তাদের বাড়িঘর, দেয়াল, পড়ার টেবিল সর্বত্রই বিভিন্ন সূত্র আর অঙ্ক মেলানোর ফর্মুলা গ্রাফিতির মতো আঁকা কিংবা লেখা দেখা যায়।
একটি গ্রামের ইস্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক এতোটা বিজ্ঞান-নিষ্ঠ হবেন, এই ২০২২ সালে সেটা আসলে আমরা ভাবতে পারি কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু হৃদয় মণ্ডলকে আমরা সেভাবেই জানতে পারলাম। তবে বেশ দেরি করে এই জানাটা হলো আমাদের। তাকে দু’সপ্তাহেরও ওপরে জেলের ভাত খেতে হলো এবং তিনি বেরিয়ে এসে দেখলেন তার পরিচিত পৃথিবী আসলে বদলে গেছে।
তিনি বিজ্ঞান পড়িয়ে যে বিজ্ঞান-মনস্ক সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন সেখানে তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তার বর্তমান ছাত্ররা তার বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ক বক্তব্যকে ভিডিও করে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং তাকে ধর্মবিদ্বেষী বিশেষ করে ইসলাম-বিদ্বেষী প্রমাণ করার জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে এবং তাকে ধরেবেঁধে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে কারণেই। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, তার প্রাক্তন ছাত্ররা এর প্রতিবাদে নেমেছে বলে কোথাও কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। বরং তার মুক্তির জন্য সেই কিছু পরিচিত প্রগতিশীল মুখই রাজপথে নেমেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র তাকে মুক্তি দিয়েছে।
হৃদয়ের গল্প থাক। আমোদিনী পালের গল্পটা দেখি আমরা। সেখানেও এক যাত্রায় দুই ফল লক্ষ্য করি আমরা। ইস্কুলের নির্ধারিত পোশাক পরে না আসায় পুরুষ ও মুসলিম শিক্ষক ছাত্রদের যে শাস্তি দিলেন সে বিষয়ে কেউ মুখ খুললো না, কিন্তু ইস্কুলের নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষক যে-ই ছাত্রীদের নির্দিষ্ট পোশাক পরে না আসার জন্য শাস্তি দিলেন তখনই সেটাকে ধর্মীয় রঙ চড়িয়ে হিজাবের বিরুদ্ধে বিধর্মী শিক্ষকের শাস্তি বলে প্রচার করা হলো এবং সারা দেশ আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে বলতে গেলে ফুঁসে উঠলো।
এমনিতেই রোজার মাস, ধর্মীয় উত্তাপ সর্বত্র লক্ষ্যমান, ফলে আমোদিনী পালকে লক্ষ্য করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্থানীয়ভাবে শুরু হলো নোংরা অপপ্রচার এবং ধর্মীয় আক্রমণ। এখানে বলে রাখা ভালো যে, যদি আমোদিনী পাল ও তার পুরুষ ও মুসলমান সহকর্মী যিনি ইস্কুলের নির্দিষ্ট পোশাক পরে না আসার জন্য ছাত্রছাত্রীদের বেত দিয়ে পিটিয়ে যে শাস্তি দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতেন তাহলে ধরে নেয়া যেতো যে, বাংলাদেশ আসলে একটু হলেও মানবিকতার পথে হাঁটছে, কারণ শারীরিক শাস্তি দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় এবং শিক্ষকের কাছ থেকে এরকম শাস্তি কোনো সভ্য দেশে আশা করা যায় না। কিন্তু সেরকমটিতো হয়ইনি বরং আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে ধর্মকে ব্যবহার করে তাকে ইস্কুল থেকে বহিষ্কারের দাবি উঠেছে।
আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করে নিলে যে বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই সেটি স্পষ্ট করে বোঝানো যাবে। ঘটনা নরসিংদীর রায়পুরায় (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১০ এপ্রিল, ২০২২)। নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি তার চার বছরের কন্যাশিশুকে নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে ইমামের পেছনে মেয়েদের দাঁড়ানো নিয়ে আপত্তি তোলেন আলাউদ্দিন নামে অপর এক ব্যক্তি।
এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে নুরুল ইসলামকে মারধোর করে আলাউদ্দিনসহ অন্যান্য মুসল্লিরা। রাতে তাকে দেখতে আসে নুরুল ইসলামের ভাগ্নে লাল চাঁন এবং নুরুল ইসলামকে দেখে বাড়ি ফেরার পথে তাকেও আলাউদ্দিন ও তার সঙ্গীরা মারধোর করে গুরুতর আহত করলে তাকে প্রথমে নরসিংদী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন।
আহত লাল চাঁনকে উত্তরায় একটি হাসপাতালে নিয়ে আসার পর চিকিৎসকগণ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ভেবে দেখুন, ধর্মীয় অস্থিরতা কিংবা অসহিষ্ণুতা ঠিক কোন্ স্তরে পৌঁছালে মসজিদে ইমামের পেছনে একটি মেয়েশিশু দাঁড়ানোর ঘটনাকে কতোটা হিংস্র ও ভয়ংকর জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলা যায়।
ওপরের তিনটি ঘটনার প্রথম দু’টিতে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়ের সদস্যদের চিহ্নিত করা হলেও পরবর্তী ঘটনাটি ঘটেছে সংখ্যাগুরু মুসলিমদের মধ্যেই। অর্থাৎ এই সহিংসতা কিংবা উগ্রবাদের শিকার কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই নয়, বরং এর শিকার সংখ্যাগুরু অর্থাৎ মুসলিম নিজেও। এসব ক্ষেত্রে একটিই সাধারণ সূত্র রয়েছে, আর তাহলো ধর্ম। অথচ ধর্ম মানুষকে ন্যুব্জ-নত হতে বলে, শান্তির কথা বলে এবং মানুষের ভেতর মানবতাকে জাগিয়ে তোলার কথা বলে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি উঠতি অর্থনীতির দেশে ধর্মকে এই মুহূর্তে যেন সকল প্রকার সহিংসতার হাতিয়ার করে তোলা হয়েছে।
যদিও একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, এই ভূখণ্ডে ধর্মকে সকল প্রকার সহিংসতা, বিভ্রান্তি এবং বিভাজনের হাতিয়ার করে তোলার রাজনীতিটা নতুন নয়। স্মরণ করতে হবে ১৯৭১ সালকে যখন ধর্মের দোহাই দিয়ে এদেশে গণহত্যা করেছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তার সঙ্গে সহযোগিতা করেছে এদেশেরই রাজাকার বাহিনী। তাদের এই ভয়ঙ্কর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলো তখন এই ধর্মাশ্রয়ী শক্তিটি কী প্রকারে বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুনরায় এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সহিংসতাকে ফিরিয়ে এনেছিলো তার ইতিহাস আমাদের সকলেই কমবেশি জানা।
আমরা হয়তো স্বীকার করতে চাই না কিন্তু একথা সত্য যে, আজকের বাংলাদেশে যে ধর্মীয় উল্লম্ফন তার সূত্রপাত ও বাড়-বাড়ন্ত এদেশে রাজনৈতিক শক্তির হাত ধরেই হয়েছে। একপক্ষ তাদেরকে কম মূল্য দিলে আরেক পক্ষের ঘাড়ে চড়ে বসে তারা রাজনীতি করেছে। কখনোই তাদেরকে ঘাড়-ছাড়া হতে হয়নি। ফলে সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পরিবার সর্বত্র এই ধর্মকে দিয়ে বিদ্বেষ, সহিংসতা, বিভ্রান্তি এবং বিভেদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এই জগদ্দল পাথরকে সরানো কারো পক্ষে সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের এই ধর্মভিত্তিক উন্মাদনা গোটা বিশ্বেই এখন আলোচনার বিষয় বটে। হৃদয় মণ্ডল, আমোদিনী পাল কিংবা তারও আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনাসমূহ বেশ ফলাও করেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। প্রতিবেশি ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা চরম আকার ধারণ করায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
২০০২ সালের ১৯ নভেম্বর বিবিসি বাংলা “বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটছে যেসব কারণে” শীর্ষক এক বিশ্লেষণে দাবি করছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক শক্তিগুলো নানা কারণে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছে। এটাও নতুন আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক ভাবে বাঙালি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের যদি উগ্রবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাহলে তার চড়া মূল্যই দিতে হবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নাগরিককে।
যে চ্যালেঞ্জের কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম সেটা দিয়েই শেষ করি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সামনে যে ক’টি বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই ধর্মভিত্তিক উন্মাদনা এবং রাজনীতির চ্যালেঞ্জ। একুশ শতকের আধুনিক বিশ্বে যে চ্যালেঞ্জ অনেক দেশই মোকাবিলা করতে পারেনি বলে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকিস্তানকে আমরা এক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে পারি। এমনকি ভারতের মতো উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিও আজ তার ধর্মীয় উগ্রবাদের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে অনেকটাই চিহ্নিত এবং নিন্দিত।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও খারাপভাবে উপস্থাপিত হবে কারণ ‘ইসলামোফোবিয়া’র মোড়কে বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদকে আরও ভয়ঙ্করভাবে আন্তর্জাতিক ভাবে তুলে ধরার চেষ্টায় কেউ ত্রুটি রাখবেন বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এমতাবস্থায় যতোটা না সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে নজর দেয়ার দরকার তার চেয়ে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে সাধারণ জনগণের সকলেরই উচিত বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা এবং বাংলাদেশকে যাতে উগ্র ধর্মান্ধ ও ধর্মীয় উগ্রবাদের চারণভূমি হিসেবে কোথাও প্রমাণ করতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের গৌরবও যেমন আপনার-আমার তেমনই বাংলাদেশকে ধর্মীয় উগ্রবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার নিন্দার ভাগও আপনার-আমারই।