হিযবুত তাওহীদ ও দেওয়াবাগীদের ধর্মান্ধতা আর রমরমা ধর্মব্যবসায় যেভাবে প্রাণ গেলো মা ও নবজাতকের:
আমাদের এলাকার মেয়ে মরিয়ম আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু হিযবুত তাওহীদ আর দেওয়ানবাগীদের ফতোয়ার ফলে মরিয়মের স্বামী তাকে কোনদিন ডাক্তারের কাছে নেয়নি। এমনকি পুরো প্রাগন্যান্সিতে সে নানান অসুখে ভুগলেও ডাক্তারের কাছে না নিয়ে বরং পানি পড়া ঝাড়ফুকের দারস্থ হয় তকর স্বামী। এসবের একমাত্র কারন তার স্বামীর পীর ভক্তি। যা তাকে পুরোপুরি অন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ করে মরিয়মের আট মাসের সময়ে প্রসব বেদনা শুরু হয়। গ্রাম্য দাত্রীকে ডেকে আনা হয়। কিন্তু প্রথম থেকেই তো মরিয়ম চিকিৎসকের কাছে একবারো যায়নি। বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগলেও শেষ সময়ে তার জীবনে যে এমন সময় আসবে কে কল্পনা করেছিলো?
গ্রাম্য দাত্রী অনেক চেষ্টা করলেও সন্তান প্রসব করাতে ব্যর্থ হয়। সবাই মরিয়মকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য বললেও তার স্বামী দেওয়ানবাগী পীরের মুরিদ হওয়ায় তার ফতোয়া অনুযায়ী কোনভাবেই হাসপাতালে নিতে রাজি হয়না। এমন অবস্থায় মরিয়ম ও তার গর্ভের শিশুর জীবন ঝুকিতে পড়ে যায়। কিন্তু তার স্বাশির এক রোখা জেদ সে হিযবুত তাওহীদ নেতার ফতোয়া অনুযায়ী চলতে থাকে প্রয়োজনে তার সন্তান মারা গেলেও সেটাতেও তার ভ্রক্ষেপ নেই। হাসপাতালে পুরুষ ডাক্তার যদি তার স্ত্রীকে দেখে তাতে নাকি তার ইমান ভঙ্গ হবে। যাইহোক এভাবে চলতে চলতে সন্ধ্যা নাগাদ তার প্রসূতি স্ত্রীর অবস্থা অবনতি হতে থাকে। অতঃপর তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পর আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে চুপ করে থাকতে পারিনি। পরেরদিনই নিজে বাদী হয়ে…… থানায় যাই হিজবুত তাওহীদ ও দেওয়ানবাগিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। কিন্তু থানার কর্তব্যরত ইনচার্জ বলে দেয় যে আমার মামলা তারা নিবে না বরংচ ভুক্তভোগীর স্বামীকে আসতে। এবং আমাকে বেশি বাড়াবাড়ি না করজর জন্য হুমকি দেয়।
দেওয়ানবাগীর পীরমুরিদের ভয়ংকর কারসাজি–
কুসংস্কার আর ভন্ডামির আরেক কুরুক্ষেত্র এই দেওয়ানবাগীর ভন্ড পীর আর তার মুরিদগন। বাংলাতেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জ থেকে শুরু করে এহেন কোন জায়গা নাই যেখানে তারা সরল সোজা। মানুষদের আটকানোর জন্য টোপ ফেলে নাই। গ্রামের সরল সোজা মানুষদের ইসলামের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোই তাদের মুল টার্গেট। এই দেওয়ানবাগীরা সারা দেশে বিভিন্ন অবান্তর সব তথ্য ছড়িয়ে ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে যেমন- নারীদের ১২-১৪ বছরের ভেতর বিয়ে দিতে হবে। ঘরের বাইরে নারীদের বের হতে দেয়া যাবেনা। কোন নারী কোন পুরুষ ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা নিতে পারবেনা। ইত্যাদি আরো অনেক আজগুবি ফতোয়া জারি করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে দেওয়ানবাগি পীর আর তার মুরিদেরা। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে আওয়ামিলীগের কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতা যারা দেওয়ানবাহীদের কথায় মজে পুরোপুরি তাদের কন্ট্রোলে। আর দেওয়ানবাগী পীর এটারই সুযোগ লুফে নিয়ে সরকারি ক্ষমতাকে কাজো লাগিয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করে মানুষকে আরো বেশি করে বিভ্রান্ত করে সমাজকে কন্ট্রোল করার জন্য আজগুবিসব ফতোয়া জারি করছে। এসব আজেবাজে ফতোয়া শুনে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ন্থীর থাকতে পারেনা।
একইভাবে হিজবুত তাওহিদ র দেওয়ানবাগীদের ভন্ডামিকে মানুষ ধর্মের রীতি ভেবে আগলে নিচ্ছে। যা সমাজে ছড়াচ্ছে মারাত্মক বিপর্যয়। সমাজে নারী বিদ্বেষকে উস্কে দিচ্ছে তারা। নারীরা হয়ে পড়ছে অসহায়। এমন অবস্থায় নিজের বিবেকের কাছে জবাব দিতে পারছিলাম না আমি। একজন শিক্ষিত সচেতন নাগরিক হিসেবে চুপ করে মানুষের মৃত্যু হাহাকার বিপর্যয় এসব বসে বসে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই নিজের বিবেকের তাড়নায় তাদেরকে নিয়ে না লিখে আর পারলাম না। তাদের এ চেহারা জনগনের কাছে প্রকাশ করা জরুরী মনে করেছি।
হিযবুত তাওহীদ কারা–
হেযবুত তওহীদ বাংলাদেশ ভিত্তিক একটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন যারা জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কালো তালিকাভুক্ত।
এটি মূলত একটি ধর্মীয় গোড়ামিকে লালন করে এমন একটি দল বা গোষ্টি। ধর্মীয় জ্ঞানের বালাই নাই বরং ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী একটি দল এই হিজবুত তাওহীদ।যারা ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে এবং টার্গেট করছে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে । বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর ফতোয়া দিয়ে মানুষকে বিপথে নিচ্ছে তারা। এমনকি জঙ্গিবাদকে উস্কে দেওয়ার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
কয়েক বছর আগে উগ্রবাদ ও নানামাত্রিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল হেযবুত তাওহীদ নামক এই সংগঠন। হেযবুত তাওহীদ বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন সম্পৃক্ত না হন, সে-ব্যাপারে কয়েক বছর আগে একটা নির্দেশনাও এসেছিল সরকারের তরফ থেকে। ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল।
এর পরে ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ সংগঠন হিজবুত তাওহীদ বা এর কোনো অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে যোগ না দিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেসব ‘সন্দেহভাজন’ সংগঠন নিষিদ্ধকরণের পর্যলোচনার তালিকায় আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হেযবুত তাওহীদ। কয়েক বছর ধরে সংগঠনটি প্রচারণার নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। দলীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন নামে সভা-সেমিনার করছে তারা। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরসহ গণমাধ্যম অফিসে তারা তাদের প্রচারপত্র বিলি করছে। তারা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নিজেদের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করারও চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে গোয়েন্দাদের এই সূত্র থেকে। এবং একাজে তারা পুরোপুরি সফল বলেও ধারনা করা হচ্ছে। কারন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতা কর্মীরা ইদানিং হিজবুত তাওহীদের নেতাদের কথায় উঠে আর বসে। বর্তমানে তাদেরকে পুঁজি করে হিজবুত তাওহীদ বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গিবাদ সহ বিভিন্ন অবাজকতা ছড়াচ্ছে।
ধর্ম একটি শ্বাশত জীবন ব্যবস্থা। ধর্ম মানুষের সমাজ আর জীবনকে করে সুন্দর। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের নামে মানুষকে করছে বিভ্রান্ত আর বিপদগামী। ধর্মের নামে সমাজে ছড়াচ্ছে বিশৃঙ্খলা।
মানুষের মতো দেশেরও শরীর এবং আত্মা আছে। ভূখণ্ড, জনসংখ্যা, শাসনব্যবস্থা হলো একটি দেশের শরীর। আর আত্মা হলো রাষ্ট্রীয় আদর্শ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা, সাংবিধানিক ঘোষণা ও অঙ্গীকার, দেশের মানুষের মন-মানসিকতা, মূল্যবোধ, চেতনা, শিক্ষা, রুচি, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মানবিক অনুভূতি, সৃজনশীলতা, চিন্তাশীলতা ইত্যাদি। আমরা রাষ্ট্রের শরীর মোটামুটিভাবে ঠিক রাখতে পারলেও আত্মাকে ঠিক রাখতে পারিনি। আমাদের দেশের আত্মা ক্ষতবিক্ষত। ধর্মান্ধতা ও ধর্মোন্মাদনা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, মানুষে মানুষে বিভেদ, বৈষম্য। দেশের এই ক্ষতবিক্ষত আত্মা সারানোর উদ্যোগ কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে আমাদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেশে সবচেয়ে বেশি বাড়-বাড়ন্ত। এখানে একদল মানুষ ওৎ পেতে বসে থাকে কিসে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ লাগে, কে কোথায় ধর্মাচার লঙ্ঘন করছে, সেটা খুঁজে বের করার জন্য। যুক্তিবুদ্ধিবিবেক বিসর্জন দিয়ে মানুষের মধ্যে সংকীর্ণ ধর্মীয় অনুশাসন মানা এবং মানানোর প্রবণতা সীমাহীন বাড়ছে। যারা কট্টর ধর্মীয় বিধান মেনে চলে না, তাদের উপর নেমে আসছে অপমান, নির্যাতন। নিজের মতো চলতে, স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে বা স্বাধীনভাবে লেখালেখি করতেও মানুষ ভীত-শঙ্কিত, কারণ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা।
অন্যের মতো, আদর্শ, বিশ্বাস, ব্যবহার, আচরণ যারা মানতে আগ্রহী নয়, তাদেরই অসহিষ্ণু বলি আমরা। এই অসহিষ্ণুতা ক্রমেই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর, শিক্ষিত ও নিরক্ষরের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। এখনও নারীর প্রতি পুরুষ অসহিষ্ণু। গরিবের প্রতি ধনী অসহিষ্ণু। এক ধর্মের লোক আর এক ধর্মের লোকদের প্রতি, এক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ আর এক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষের প্রতি অসহিষ্ণু। খুনখারাপি করলেই সে অসহিষ্ণু, তা না হলে নয়— তা তো নয়। যারা টিপ পরার ‘অপরাধে’ নারীকে অপমান করছে, বিজ্ঞান ও ধর্ম যে আলাদা, একটার ভিত্তি যুক্তি ও প্রমাণ, অন্যটির ভিত্তি বিশ্বাস, এই কথা বলাতে বিজ্ঞানের শিক্ষককে কাঠগড়ায় তুলছে, তারাও অসহিষ্ণু। শুধু অসহিষ্ণু নয়, তারা বর্বর, ধর্মান্ধ।