ধর্ম ও রাষ্ট্রের অবস্থান, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক, পারস্পরিক সম্মানবোধ ও অধিকারের স্বীকৃতি এবং তার বাস্তব প্রয়োগ, গণতন্ত্রের প্রাথমিক ও মৌলিক মাপকাঠি- এসব বিষয় নিয়ে শত শত বছর আগে থেকে পৃথিবীব্যাপী মানুষ আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেসব সিদ্ধান্তে এসেছে, সেগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত আদর্শগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইউরোপে চার্চের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক, আলাপ আলোচনা, লড়াই-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস সম্পর্কে বিশ্ববাসী অবহিত। বহু আগে এসবের ইতিও ঘটেছে। তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল- রাষ্ট্রের ওপর চার্চের কোনো প্রাধান্য থাকতে পারবে না। চার্চ মানুষের ঐচ্ছিক এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রার্থনা গৃহ। কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করে; তাই রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার- এ বিষয়টি দীর্ঘকাল আগেই অবিতর্কিতভাবে মীমাংসিত।
যে কোনো ধরনের উগ্রতা তা জাতীয়তা নিয়েই হোক বা ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে; তা মানুষের জীবনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করতে গিয়ে হিটলার জার্মানির শান্তিপ্রিয় অধিবাসীদের জীবনে কী মর্মান্তিক বিপর্যয়ই না ডেকে এনেছিলেন! ধর্মীয় উগ্রতার পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তার প্রকৃত উদাহরণ। তারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়া দূরের কথা; প্রত্যক্ষভাবে তার বিরোধিতা করেছে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত নির্মম গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়েছে সক্রিয়ভাবে। অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীকে। তারা কি জানত না- মুক্তিযুদ্ধের আহ্বানকারী, মুজিবনগরের মন্ত্রিসভা, সংসদ সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধারা ৯৫ শতাংশের বেশি মুসলমান? ঠিকই জানত। জেনেই তারা ওই বর্বরতা ও নিপীড়ন-নির্যাতনকে সর্মথন জানিয়েছে। সহযোগিতাও করেছে। কিন্তু তখন পাকিস্তান যা করেছে তার কোনোটিই কি সমর্থনযোগ্য ছিল- ধর্মীয়, গণতান্ত্রিক, মানবিক বা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে?
প্রায় এক দশক যাবৎ দেখা যাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎপত্তি ঘটেছে আইএস নামক একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের। তারা সারাবিশ্বের সমমনা বিত্তশালীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা নিয়ে বিস্তর অস্ত্রশস্ত্র কিনে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের নামে মানবহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ দেশের সরকার কঠোর উপায়ে আইএসকে দমন করেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এখনও আইএসের দখলে। তারা ধর্মের নামে পৃথিবীর সব দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার কথা বলে অনেককে রিক্রুট করে।
আজও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ওই জঙ্গিদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ড অব্যাহত। সেখানে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে; হতাহত হচ্ছে। বহু মসজিদ বোমার আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এর সমাপ্তির কোনো লক্ষণ আজও দেখা যাচ্ছে না। লক্ষণীয়, ধর্মের নামে মানুষ খুন করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না। তারা মসজিদগুলোকেও ধ্বংস করে দিতে পরোয়া করছে না।