দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন। বিভিন্ন শাখার বেশকিছু কর্মকর্তার অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্নীতির ফলে নষ্ট হচ্ছে নগর ভবনের সুনাম। তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকলেও যথাযথ কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই প্রতিটি কর্মকর্তাই একসময় প্রয়াত সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ঘনিষ্ট হলেও পরবর্তিতে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান মেয়রের ছত্রছায়ায় তারা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি দুর্নীতির ফলে অন্তত ২২ কোটি টাকার রাজস্বও ঘাটতি রয়েছে।
জানা যায়, সিসিকের অভ্যন্তরীণ আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে হোল্ডিং ট্যাক্স। রাজস্ব বিভাগের দুটি আলাদা উপশাখা কর ধার্য ও কর আদায় শাখার মাধ্যমে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও আদায় করা হয়ে থাকে। কর ধার্য (এসেসমেন্ট) শাখার কর্মীরা বিভিন্ন হোল্ডিং সরেজমিন পরিদর্শন করে মাপজোক শেষে প্রদেয় কর নির্ধারণ করে কর আদায় শাখায় পাঠায়। সেই অনুযায়ী কর আদায় শাখা হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করে। কিন্তু কর ধার্য (এসেসমেন্ট) শাখার প্রধান চন্দন দাশ ও কর আদায় শাখার প্রধান মো. রমিজ মিয়া বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে গত ১০ বছরে সিসিকের অন্তত ২২ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছেন। আর নিজেরা হয়েছেন কোটিপতি।
সূত্র মতে, কর ধার্য শাখা প্রধান চন্দন দাশ গত ১০ বছর ধরে তার অধস্তন কর্মীদের চাপ দিয়ে দুই হাজারেরও বেশি ভবন কর আদায়ের বাইরে রাখেন। নামমাত্র হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করে ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন আর্থিক সুবিধা। দীর্ঘদিন এ ধরনের অনিয়ম হয়ে আসলেও তা প্রকাশ পেত না। হঠাৎ গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশ পায় এই অনিয়মম–দুর্নীতির বিষয়।
গত বছরের আগস্টের শেষ দিকে ১২টি ওয়ার্ডের অন্তত আড়াইশ’ বাসিন্দার নামে নোটিশ জারির জন্য কর আদায় শাখাকে সুপারিশ করেন কর ধার্য শাখাপ্রধান চন্দন দাশ। যাদের প্রায় সবারই হোল্ডিং ট্যাক্স বকেয়া ১০ বছরের বেশি। এতেই নড়েচড়ে বসে নগর ভবন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই হাজারের অধিক ভবনে গত ১০ বছর কোনোরকম এসেসমেন্টই হয়নি। এমনকি ৫ বছর অন্তর যে বিভাগীয় এসেসমেন্ট হয় তাতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এসব ভবনকে। ঘটনা প্রকাশ পেলে গত ৭ সেপ্টেম্বর সিসিক সচিব ফাহিমা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত এক পত্রে ওএসডি করা হয় চন্দন দাশ ও রমিজ মিয়াকে। এর এক সপ্তাহ পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর সিসিকের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে গঠন করা হয় ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি। তবে নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে আটকে রাখা হয় তদন্ত। এর দেড় মাস পর গত ৩০ অক্টোবর সিসিক সচিব ফাহিমা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে তদন্ত কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় মেয়রের একান্ত সচিব সোহেল আহমদকে। আর মৌখিক নির্দেশে বাদ দেয়া হয় প্রকৌশল শাখার সার্ভেয়ার বিজিত চন্দ্র দেকে। এরপর আরও দুই মাস পেরোলেও রিপোর্ট জমা দিতে পারেনি ৪ সদস্যের এই কমিটি।
এ ব্যাপারে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি সিসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. মতিউর রহমান খান।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির এক সদস্য গণমাধ্যমে বলেন, বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সিসিককে অন্তত ২২ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া এসব হোল্ডিং থেকে আর্থিক সুবিধা নেয়ার ব্যাপারটিও তদন্তে পাওয়া গেছে।
তবে কর ধার্য শাখার প্রধান চন্দন দাশ নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। আমাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে, তবে আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই।
এদিকে একসময়কার সেলসম্যান হানিফুর রহমান এখন সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। যিনি কি–না বর্জ্য থেকেও ঘুষ আদায় করেন। মেয়রের গ্রামের বাড়ি একই জেলায় হওয়ায় তিনি তার ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত। প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ ছাড়াও কনজারভেন্সি শাখার দায়িত্বে আছেন হানিফুর রহমান। তার হাত দিয়েই হয় নগরভবনে নিয়োগ বাণিজ্য। এ যাবত তার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে অর্ধশতাধিক নিজ উপজেলা কমলগঞ্জের বাসিন্দা বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে কনজারভেন্সি শাখাসহ বিভিন্ন শাখায় হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার দাগি অপরাধীদের চাকরি দিয়েছেন। এসব অপরাধীকে নিয়োগ দিয়ে দাপট খাটান তিনি। তার নিকটাত্মীয় এমন ৫–৭ জনকেও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
এছাড়া দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা লোকজনের কাছ থেকেও টাকা কেটে রাখা এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও মার্কেট, বিপণিবিতান থেকে ময়লা আবর্জনা অপসারণে কর্মীদের দিয়ে টাকা আদায় এবং ফুটপাতে বসা হকারদের কাছ থেকেও দৈনিক টাকা উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
হানিফের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামে রয়েছে অনেক সম্পদ। ২০০১ সালে সিসিকে চাকরি নেয়ার আগে সোয়ান ফোম কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে কাজ করা হানিফ এখন বাড়ি–গাড়ি, জমিজমা, অট্টালিকার মালিক। সিলেট সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ করা প্লটও রয়েছে তার স্ত্রীর নামে।
কমলগঞ্জের আদমপুরে বিশাল এলাকাজুড়ে তার মায়ের নামে আরএম ডেইরি ফার্ম গড়ে তুলেছেন হানিফ। যে ফার্মে বিনিয়োগ করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। ফার্মে রয়েছে দেশি–বিদেশি দেড় শতাধিক গরু। রয়েছে মৎস্য খামারও। প্রায় সাড়ে ৩ একর জায়গা জুড়ে গরুর জন্য উন্নত জাতের ঘাসেরও চাষ করেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, এক দশক আগে হানিফের তেমন কিছু ছিল না। কেবল সিটি করপোরেশনে চাকরির সুবাদে তিনি অঢেল সম্পদের বনে গেছেন। নামে–বেনামে আরও অসংখ্য জমিজমা রয়েছে তার। তার খামারে সিলেট সিটি করপোরেশন বিলবোর্ডের লোহার পিলার লাগানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিসিকের বিলবোর্ডের খুঁটিগুলো নগরীর দক্ষিণ সুরমার মেনিখলায় হানিফের বন্ধু সেলিমের মাধ্যমে আদমপুর পাচার করা হয়েছে। তবে হানিফের দাবি তিনি চট্টগ্রাম থেকে তা ক্রয় করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লোক নিয়োগ, দৈনিক মজুরিতে কাজ করা কনজারভেন্সি শাখার কর্মীদের বেতন কর্তন করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হানিফ। সিসিকের ২৮ লাখ টাকা মূল্যের ৫৩৫টি পানির মিটার গায়েবের ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটিতেও ছিলেন হানিফ। এ ঘটনায় ৮ জনকে বরখাস্ত করা হলেও তদন্তে চারজনকে অভিযুক্ত করলেও শাস্তির বিষয়টি অজ্ঞাত থেকে যায়।
নগরের বাগবাড়িতে তার স্ত্রীর নামে নেয়া প্লট উল্টে কসাইখানার জন্য সিসিককে ভাড়া দিয়েছেন। তার স্ত্রী মেহেরুননেছা ওই প্লটের ভাড়া ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা বৃদ্ধির জন্য গত বছরের আগস্টে সিসিক কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদনও করেন। ওই আবেদনে মেহেরুন নেছা তার স্বামীর পরিচয় গোপন রেখে বাবার নাম মো. খতিব মিয়া লিখেন।
এছাড়া নগরীতে নামে বেনামে সম্পদ গড়ে তুললেও চৌহাট্টা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন হানিফুর রহমান।
অভিযোগের বিষয়ে হানিফুর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, আমি ২০০১ সালে সিটি করপোরেশনে চাকরি নিয়েছি। লোক নিয়োগ হয় আমার মাধ্যমেই।
তবে তার নিজের স্বজনদের নিয়োগ ও অর্থের বিনিময়ে নিয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
গ্রামে ডেইরি ফার্মটি উদ্যোক্তা তার স্ত্রী বলে দাবি করে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী সিলেট থেকে ও মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে ফার্মটি দেখাশোনা করেন। অথচ ডেইরি ফার্ম নিয়ে তৈরি একটি ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, তার স্ত্রী মেহেরুন্নেছা গ্রামে থেকেই এসব দেখাশোনা করেন। প্রায় দেড় একর জায়গা জুড়ে ফার্ম ও ১২ কেদার জায়গাতে গরুর ঘাস চাষের কথা স্বীকার করেন তিনি। একটি পক্ষ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত বলে দাবি তার।