জঙ্গিবাদ বা ধর্মীয় উগ্রবাদ উত্থানের কারণ কী? মোটাদাগে দুটি কারণকে তুলে আনা যায়। একটা হচ্ছে- হতাশা । প্রতিশোধস্পৃহা । আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সঠিক শিক্ষার অভাব ।
দীর্ঘদিন নির্যাতন নিপীড়ন শোষণ বঞ্চনার শিকার হলে যেকোন জনগোষ্ঠীই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । যখন বঞ্চনার জায়গা থেকে উত্তরণের স্বাভাবিক কোন পন্থা থাকে না, নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা কাজে আসে না, তখন মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে । শুধু মানুষ নয়, যে কোন প্রাণীই সহিংস হয়ে ওঠে ।
মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে প্রতিশোধপরায়ণতা । এ উপমহাদেশ থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের সকল উগ্রবাদীদের উত্থানের পেছনে এই কারণটিই প্রধান । এমনকি ঐতিহাসিক ব্রিটিশ বিরোধী সহিংস আন্দোলনসহ বিশ্বের প্রায় সকল সহিংস আন্দোলন-সংগ্রাম বা যুদ্ধের পেছনের কারণ এটিই ।
ইসলামকে পুঁজি করে যে উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে, যার ঢেউ এসে পড়েছে আমাদের দেশেও, তারও প্রধান কারণ এটি । আমরা দেখি, আইএস আল কায়েদা এইসব গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের হতাশা থেকে, ক্ষোভ থেকে । প্রতিশোধস্পৃহা থেকে । ইরাক যুদ্ধ, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ- এইসব ঘটনার পরেই ক্ষুদ্র উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো ফুলে ফেপে উঠেছে । আরো বেশি মানুষকে তাদের দলে ভিড়াতে পেরেছে । আরো বেশি শক্তি সঞ্চার করতে পেরেছে । সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, এইসব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তরুন যুবকেরাই আইএস আল কায়েদার মূল শক্তি । পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জীবন সম্পর্কে হতাশ, রেডিকালি চেঞ্জড কিছু যুবক তাদের সাথে যোগ দিয়েছে ।
আইএস সহ উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিম তরুনদের মাঝে একটা ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে- দেখো, সারাবিশ্বে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে । আর ইহুদী খ্রিস্টান অমুসলিমরাই হচ্ছে নির্যাতনকারী । অতএব তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে হবে । তাদেরকে খুন করতে হবে ! আর বিশ্বের মুসলিমদের দুরবস্থায় হতাশ তরুণরা আবেগে জড়িয়ে পড়ছে উগ্রবাদী সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে । যোগ দিচ্ছে নিরীহ নিরপরাধ মানুষ হত্যার মত জঘন্য কাজে ।
মুসলিমরা অবশ্যই নির্যাতিত হচ্ছে, এই বাস্তবতা কারো অস্বীকার করার সুযোগ নেই । কিন্তু তাই বলে অন্য কোন নিরীহ মানুষকে হত্যা তো দূরের কথা, সামান্য ক্ষতি করার অনুমতিও ইসলাম দেয় না । কুরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা একজন নিরীহ মানুষ হত্যাকে পৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যার সমান বলে ঘোষণা করেছেন ।
নিরীহ মানুষ হত্যার ব্যাপারে উগ্র গোষ্ঠীগুলো মুসলিম যুবকদের ধারণা দেয় যে- ইহুদি খ্রিস্টানরাও তো নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করছে ! অতএব তোমরা করলে দোষ কী? সঠিক ইসলামী শিক্ষা না পাওয়া আবেগি মুসলিম তরুনেরা এইসব কথায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের পথে ।
তাদেরকে isolated ভাবে কুরআনের এমন কিছু কিছু আয়াত থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়, যেখানে ‘ক্বিতাল’এর কথা বলা হয়েছে । কিন্তু কখন, কোন্ প্রেক্ষাপটে, কেন সেইসব আয়াত নাযিল হয়েছিল তা বলা হয়না । তারা নিজেরাও জানার সুযোগ পায় না, চেষ্টা করে না । আগে থেকে ইসলামের শিক্ষা না থাকার ফলে তাদের ধারণা হয়ঃ ঠিকই তো ! এগুলো তো কুরআনেরই কথা !
অথচ Context ছাড়া কুরআনের কোন Text থেকে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই । যদি তাই হতো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা শুধু বই আকারে কুরআন নাযিল করতেন, রাসুল পাঠাতেন না । সমগ্র কুরআন একসাথে নাযিল করতেন, ২৩ বছর সময় দিতেন না ।
কারা বেশি করে জড়াচ্ছে উগ্রপন্থায়? যারা জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে । ফলে হঠাৎ করে যখন তারা জীবনে কোন একটা বড় ধাক্কা খায়, যখন কোনভাবে তার মনে হয়- কী করছি আমি এসব? আমি তো অনেক পাপ করেছি, হায় হায় আমার কী হবে ! আমার তো দুনিয়া আখেরাত সব বরবাদ হয়ে গেলো ! ঠিক এসময়ই তারা সন্ধান পায়, অথবা তাদেরকে খুঁজে নেয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী । তাদেরকে বলা হয়- আল্লাহর কাছে মাফ পেতে চাও? তাহলে এই নাও অস্ত্র! খুন করে ফেলো ওকে-তাকে । ওরা ইসলামের শত্রু ! ওদেরকে মেরে নিজেও মরে যাও , শহীদ হয়ে যাও ।
শহীদ(?) হবার এই সহজ রাস্তা পেয়ে আবেগি তরুন নেমে পড়ে মানুষ হত্যায় । এমনিতেই সে ছিল জীবন সম্পর্কে হতাশ, ক্ষুব্ধ । এমনিতেই সে ছিল জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ । তারপর যখন উগ্রবাদীরা তার সামনে আত্মাহুতি দেয়ার একটা ‘মহান’ (?) কারণ দাঁড় করায়, অস্থিরহৃদয় যুবক তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে । কারণ- সারাটা জীবন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান মেনে চলার চেয়ে হঠাৎ আবেগে জীবন দেয়াটা অনেক সহজ ।
উল্টোদিকে যারা ছোটবেলা থেকেই ইসলামের শিক্ষা পেয়ে, ধর্মীয় আচার আচরণের মধ্যে বড় হয়- তাদের ভেতর একটা তৃপ্তি থাকে- আমি ধর্মের পথেই আছি । ফলে তাদেরকে র্যাডিকালাইজড করা সম্ভব হয় না ।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে- ধর্মীয় শিক্ষা নেবার জায়গাটা । এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । তরুণদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে । ধর্ম নিয়ে, জীবন নিয়ে । এইসব প্রশ্নের জবাব সে কোথায় পাবে? প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়ার জায়গাটা হাতের কাছে থাকতে হবে । ধর্মীয় বই পুস্তক, ধর্মীয় নেতা, আলেম ওলামাদের গতিবিধি, মাহফিল মজলিশ মক্তব মাদ্রাসা ওয়াজ নসিহত বক্তৃতা সীমিত হয়ে পড়লে সেই জায়গাটা দখল করে নেয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী । ফলে মানুষের বিপথগামী হবার সুযোগ সম্ভাবনাও বেড়ে যায় ।
বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা যতটুকু বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে তার পেছনে এইসব কার্যকারণ জড়িত আছে । বিগত বছরগুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ দিনকে দিন সীমিত হয়েছে । অনেক মক্তব মাদ্রাসা, ধর্মীয় জলসা মাহফিল মজলিশ টিভি পত্র পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে । আর এর সুযোগটা নিতে পেরেছে উগ্রবাদীরা । ফলে তরুণ- যুবকদের একটা অংশকে বিপথগামী করার সুযোগ পেয়েছে উগ্রবাদিরা । ধর্মের শিক্ষার পথ বন্ধ করা নয়- বরং সহজলভ্য করতে হবে । যাতে তরুণ মনের প্রশ্নগুলো উত্তর খুঁজে পায় পিতামাতার কাছে, শুভাকাঙ্খি কারো কাছে । পরিচিত কারো কাছে ।
আর যারা ইসলামের যৌক্তিক ব্যাখ্যা জানে, শেখে, বোঝে, তাদেরকে বিপথে নেয়া কারো জন্য সহজ হয় না । তাদেরকে র্যাডিকালাইজড করা যায় না ।