Emdadul Mia

কুসংস্কার সমাজে পুরোপুরি আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলেও সমাজের বৃহৎ অংশ কুসংস্কার দ্বারা অন্ধ বিশ্বাসে আচ্ছন্ন।

কুসংস্কার সমাজে পুরোপুরি আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলেও সমাজের বৃহৎ অংশ কুসংস্কার দ্বারা অন্ধ বিশ্বাসে আচ্ছন্ন। সেই অতীতের হিপোক্রাটিস খেকে শুরু করে বর্তমান বিজ্ঞান যুগের মহামনীষিরা কুসংস্কার ভেঙ্গে সত্য বিশ্বাসে সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এত চেষ্টা স্বত্যেও পুরোপুরি সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করা গেল না। তাই আমাদের মধ্যে এত বিভিন্নতা। কেউ কেউ কুসংস্কার মুক্ত হয়ে সুখী জীবন গড়তে চায় কেউবা কুসংস্কারের মাঝে সুখ খুঁজে বেড়ায়। তবে সভ্যতার উন্নতির নব নব ধাপে কুসংস্কার সমাজ থেকে বিতাড়িত হবে। কুসংস্কারের জন্য সমাজের অধিকাংশ মানুষ কত যে বোকা হয়ে আছে এবং গড্ডালিকার প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, তা আমাদের চারপাশে তাকালেই মালুম করা যায়।

পাশের বাড়ির লোক। সংসারের মোট সদস্য সংখ্যা বার জন। এ সময়ে বার জন সদস্যের এক সংসার মেন্টেইন করা যে কত বড় কঠিন কাজ তা যে সংসার চালায় সেই বোঝে । অর্থের উৎস বলতে ঠোঙ্গা বানিয়ে বিক্রি করা। তাতেও বিভিন্ন সমস্যা। কাগজ থাকেতো অন্যান্য উপাদান থাকে না। অন্যান্য উপাদান থাকেতো কাগজ থাকে না। এর উপর গৃহকর্তা যা উপার্জন করে, তা যে পথের আয় সে পথেই ব্যয়। লাভের অংশ যায় উবে । পুঁজি ফিরত আসলে তা ভাগ্যের ব্যাপার।

অনেক মানুষ আছে যাদের স্থায়ী কর্মে ধৈর্য নাই। নাটক অথবা সিনেমায় দেখা যায় নায়কের চাকুরীর সিরিয়াল নম্বর ১৫ কিংবা ২০। যদিওবা চাকুরী হয় তা আবার বেশী দিন স্থায়ী হয় না। কারণ নায়কের মর্জির সাথে কাজের মিল নাই। আবার দেখা যায় নায়ক বেকার সমস্যা হেতু বিভিন্ন প্রকার কুকর্মে লিপ্ত। আমার ভাইর অবস্থা হল চাকুরীর নম্বরের মত। দোকান দেওয়া এবং দোকান গুটানো কয়েক দফা শেষ হয়েছে কিন্তু একেবারে সমাপ্ত হয় নাই। দোকানের শুরুতে পুঁজি মোটামুটি ভালোই থাকে কিন্তু কয়েকদিন পর পুঁজি থাকে না, লাভতো দূরের কথা। অনেকে ভাবতে পারেন পুঁজি সংসারের শক্তঘানি গ্রাস করছে আসলে কিন্তু তাও না। প্রধান কারণ হল বকেয়া। আমার বাবা মাঝে মাধ্যে তাকে উপদেশ দেয় ব্যবসার খাতিরে আপনকে সাধারন করতে হয়। তাহলেই ব্যবসায় সফল হওয়া যায়। কথাটা ভাল, কথাটা সত্য। সত্য এই কারণে যে, বকেয়া দিয়ে শূন্য হয়ে বসে থেকে প্রয়োজনে উচ্চবাক্য করা যায় না পাছে যদি লোকে দূর্নাম রটায়। তাই ব্যবসার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রটাই ভাল। বর্তমানে আমার ভাইর অবস্থা মরাও দায়।

স্ত্রী সংসারের সম্পূর্ণ ঘানি বহন করে এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে তেমন দেখা যায় না। দৃষ্টান্তের মধ্যে আমার ভাইর সংসারের চালিকাশক্তি তার স্ত্র্রী। প্রথমাবস্থায় না হলেও কয়েকবছর থেকেই তার শক্তহাতে সংসার ঠিকঠাকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এতে সভ্যতার কিছুটা উন্নতি হয়েছে কেহ যেন তা মনে না করে কারণ এ কর্ম স্বেচ্ছায় নয়, বাদ্ধ হয়ে। অনেকে বলবে সংসারইতো বাদ্ধবাধকতা। তা বটে তবে সংসারের সৃষ্টি মানুষ জীবনের পূর্ণতা হেতু এবং এর থেকে বিচ্যুত মানে জীবন সম্পর্কে উদাসীন। কে এই বদনাম মাথায় নেয় তাই সংসার পরিচালনা করতে হবেই। এখানে কার দ্বারা কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা বড় কথা নয়।

বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ধর্মীয় কুসংস্কার সবচেয়ে বেশী। সুস্থ্য ধর্ম পালনকারীরা নির্র্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের হয়ে সর্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিবিরাজের কাজ করে। যারা মহান তারা সর্ব সম্প্রদায়ের। তাদের জন্যই আমরা মানবতাবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। স্বচ্ছ জ্ঞান ছাড়া আসল ধর্মের কাজ হয় না। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে অতি ধর্ম দ্বায়িত্ববোধের ‘অতি’ অবশেষে কুসংস্কারে পরিণত হয়। ধর্মই মানুষের মুক্তি । তাই বলে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ধর্ম মানুষের মুক্তি হতে পারে না। এর উদাহরণ অনেক আছে তার কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি-

আমার বড় চাচা। বয়স আশি হবে। ছোটকালে নাকি খুব দুষ্ট ছিলেন একথা অনেকে বলেন। এখন সে অতি ধর্ম প্রাণ ব্যক্তি। তার পীরে বলেছে – “অন্যের হাতের রান্না গ্রাস করা যাবে না। খুব বেশী অসুখ না হলে ডাক্তার দেখান যাবে না, ঔষধ সেবন করা যাবে না।” এগুলো প্রকৃত ধর্ম না ধর্মীয় কুসংস্কার ?

দাড়কাকের বাসার সমতুল্য। আচ্ছাদনের পর আচ্ছাদন। সঠিকভাবে আলো-বাতাসের চলাচল নাই। তার উপর ধর্মের নামে ঘরের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকা। যাকে আমরা পর্দা বলি (ধর্মীয় পর্দা) আসলে কি ধর্মে এতটা বলেছে ? পাঠকরা আপনারা ভেবে দেখবেন।

ধর্ম রক্ষা করার জন্য পীরে যা বলে তা ভালভাবে বিচার বিশ্লেষন না করে অন্ধভাবে পালন করা কি ধর্মের রক্ষা? বিশ্বজগতে ভন্ডপীরের অভাব নাই। নিজ স্বার্থের হেতু এনেহ কার্য নাই যা তাদের দ্বারা অসম্ভব হতে পারে। সন্তান না হওয়া হেতু পীরের তদবির নিতে গিয়ে দ্বার বন্ধ হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। এ রকম হাজারও উদাহরণ দেওয়া যায় তাতে পাঠক হয়তবা বিরক্তি বোধ করবেন।

আমার ভাইয়ের বর্তমান অবস্থা ভাল না। করুনা হেতু যে দান সে দানও সে গ্রহন করে না। নিজেকে অভাবী মানুষ ভাবতে তার বেশ কষ্ট হয়। দয়া-দাক্ষিণ্য গ্রহন করতে সে পছন্দ করে না। কথায় কথায় সে অনেক কিছুই পারে কিন্তু পারছে না নিজের অভাব ঘুচাতে।

তার দুটি মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। সারাদিন কাগজের ঠোঙ্গা বানিয়ে যেটুকু সময় পায় পড়া-লেখার কাজে ব্যয় করে। তাদের ব্রেইন বেশ ভাল। অল্প পড়েই পড়া মনে রাখতে পারে। মেয়ে দু’টা দেখতেও মোটামুটি ভাল। কিন্তু অর্থের অভাবে পঞ্চম শ্রেণীর পর তাদেরকে আর পড়ান সম্ভব হয় নাই। একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে দেয়। এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে যাদের বাড়ি ঘর নাই। দু’জনেই শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে অবস্থান। তারা কোন কর্মের না। এখানে-ওখানে কাজ করে যা আয় করে তা দিয়ে সংসার চলে না। বাড়তি খরচ মিটাতে হয় শ্বশুড়েই। কেউ কিছু বললে জামাইরা কর্ণপাত করে না। তদের লজ্জাও কম।

আমার ভাইর দু’টো ছেলে। তাদের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলে পড়িয়ে মাদ্রাসায় পড়তে দিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মাদ্রাসায় পড়তে চায় না, স্কুলে পড়তে চায়। জোড় করে তাকে মাদ্রাসায় পাঠান হচ্ছে । ভাইর ধারনা মাদ্রাসায় না পড়লে মানুষ নাস্তিক হয়ে যায়। পরে মাদ্রাসায় ঠিকমত না যাওয়ার কারণে ছেলেটার লেখা-পড়া বন্ধ করে দেয়। কোন ছেলেকেই সে শিক্ষিত করতে পারলো না তার গোড়ামীর কারণে। ছেলেদুটো যা ভাল লাগছে করছে। এর মধ্যে অনেক হারাম কাজও করছে।

তার ভাইরা ঢাকাতে বেশ ভাল অবস্থাতেই আছে। একজনের নিজস্ব বাড়ি আছে। তারা এই ভাইর খেয়াল নেয় না। বছরে একবারের জন্যও বাড়িতে আসে না। তাদের বৌরা শিক্ষিত। বাচ্চা একটি কি দুটি। মাঝে মধ্যে গ্রাম থেকে ভাই শহরে গেলে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সে টাকা নিতে না চাইলেও সংসারের কথা চিন্তা করে নিতে হয়।

সংসারে রোগ-শোক যেন লেগেই থাকে। আজ এর জ্বর কাল ওর পেট ব্যাথা ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থের অভাবে ভাল কোন ডাক্তারও দেখানো সম্ভব হয় না। পুষ্টিহীনতায় ভুগছে সংসারের সবাই। রোগ-শোক হওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। এরা ঠিকমত খেতে পাচ্ছে না। ঘর ভাল না হওয়ায় সব সময়ই স্যাঁত স্যাঁতে থাকে যাতে রোগের প্রার্দুরভাব দেখা দেয়।

সামনে রোজা এবং ঈদ। সেহেরী খেয়ে রোজা রাখার মত অবস্থা তাদের মাঝে মধ্যে হয় না। ছোট-বড় সকলেই রোজা রাখা বাধ্যতামূলক। সিয়াম সাধনায় এভাবে একটি মাস কেটে যায় পরিবারের সবার। রোজা শেষে খুশির ঈদ। সকলেই নতুন পোশাক চাওয়া। বাচ্চারা ঈদের আগে প্রতিদিনই নতুন পোশাকের প্রত্যাশায় থাকে। কিন্তু তাদেরকে আশার ফাঁদে ফেলে ঈদ চলে যায়। ঈদের সময় ভালো খাবারের ব্যবস্থাও থাকে না। দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে এই পরিবার কখনও মুক্ত হতে পারছে না।

দুনিয়া সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। তারা ধর্ম সম্পর্কে বুঝত নামায পড়া, রোজা রাখা। আল্লাহ্ ও তার রাসূল কি করতে বলেছে, কি ছাড়তে বলেছে সে সম্পর্কে তাদের পূর্ণাঙ্গ ধারনা নাই। বিন লাদেনের বীরত্বের কথা শুনে তারা বেশ আশ্চর্য । বিনোদন একেবারে পছন্দ করে না। বিনোদন কি তাও বুঝে না। দূরদেশে কোথায়ও অর্থের অভাবে যায়াও হয়ে উঠে না। রাত্র দশটা তাদের জন্য গভীর রাত। গল্প, উপন্যাস যে দুনিয়াতে আছে তা তাদের ধারনার বাহিরে । ভালবাসা মনে থাকলেও প্রেম নিয়ে তারা কল্পনা করে না।

আমার ভাবী প্রায়ই অসুস্থ্য থাকে। প্রকাশ করে না। যখন অসুখের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করে তখন এমনেতেই তা প্রকাশ হয়ে যায়। প্রকাশ পাওয়ার পরও ভালো ডাক্তার দেখান সম্ভব হয় না। একদিন সে আবল – তাবল বকাবকি শুরু করল। সকলে বলল জ্বিনে ধরেছে। সারাদিন একটা রুমের মধ্যে থাকে। কারো সাথে দেখা করে না। ঠিকমত খায় না আর সকলের কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছে। একসময় সে কথা বন্ধ করে দেয়, কারো সাথে কথা বলে না। কোন কাজও করে না। বলা যায় এক রকম অ্যাবনরম্যাল মানুষ। এখন সংসারের হাল ধরেছে সংসারের বড় মেয়ে।

নিজের স্ত্রীর এই করুন দশা দেখে আমার ভাই মনোগত দিক থেকে আস্তে আস্তে ভেঙ্গে পড়তে শূরু করল। সেও কোন কাজ করতে পারছে না। সারাদিন বসে বসে দিন কাটায় । ঘরে ভাল না লাগলে বাহিরে কোথায় গিয়ে একা বসে থাকে। তার কোন বন্ধুও নাই যে মনের কথা খুলে বলবে। একদিকে সংসারের নিদারুন অভাব-অনটন, আরেক দিকে ঘরের সকলের কম-বেশী অসুখ দেখে নিজেই অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

বাজারে এখন আগের মত ঠোঙ্গার চাহিদা নাই। দিন দিন চাহিদা কমে যাচ্ছে সহজ প্রযুক্তির কারণে। সংসার পরিচালনা করা সামনে আরো জটিল থেকে জটিলতর হবে ।

সংসারের এই অবস্থা দেখে ঘর জামাইরা তাদের বউ নিয়ে ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ল। এখন সংসারে কোন মেয়ে নাই। এদিকে ভাইর শারীরিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে। একেতো সংসার চালানো তারপর রোগীদের ডাক্তার দেখানো, এই দ্বায়িত্ব কে নিবে! বড় ছেলে দর্জির কাজ শিখেছে, সেখানেই কাজ করে নিজে কোন রকম চলছে। সংসার থেকে নেওয়া ছাড়া দেওয়ার মত কোন যোগ্যতা এখন পর্যন্ত তার হয় নাই। এভাবে টানা- পোড়া এবং অসুখ-বিসুখের মধ্যে আরো দু’টো বছর কেটে গেল।

বড় ছেলে অর্থকড়ি মোটামুটি কামাচ্ছে। কিন্তু সংসারের প্রতি তার তেমন একটা খেয়াল নেই। হঠাৎ একদিন শুনলো হাসান বিয়ে করেছে। এ কথা শুনে আমার ভাই বেশ মর্মাহত। আমার ভাবি এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। একদিন সে মারা গেল। রোগে-শোকে ক্লীষ্ট হয়ে কোন রকম সংসার নিয়ে বেঁচে আছে আমার ভাই। একদিন সেও মারা যাবে।