Emdadul Mia

কুসংস্কার দূরীকরণে শিক্ষাই একমাত্র হাতিয়ার। বিপক্ষে কিছু যুক্তি দিতে পারবেন কি?

  1. একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞান- বিজ্ঞানের অসীম, অপার জয়যাত্রার মুখে দাঁড়িয়েও খুবই দুঃখের সাথে একটা কথা স্বীকার করতে হয় যে, আমাদের সমাজের অনেক মানুষ এখনো কুসংস্কারে নিমজ্জিত। এক্ষেত্রে নিঃসংশয়ে শিক্ষিত আর অশিক্ষিত উভয় শ্রেণীকেই এককাতারে ফেলা যায়। আজও গ্রামেগঞ্জে মেয়েদের শ্রী বা সৌন্দর্য বিচারের ক্ষেত্রে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী ইত্যাদি নিয়ে হাস্যকর বিভাজন চলে। এখনও অনেককেই দেখি, একশালিক দেখলে দিনখারাপের অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন হতে। সংবাদপত্র খুলেই প্রথমেই ‘আজকের দিনটা কেমন যাবে’- কলামটিতে চোখ না বুলিয়ে অনেক শিক্ষিত লোক ঘর থেকে বের হন না। ঘর থেকে বেরোবার সময়, অসাবধানতাবশত হোঁচট খেলে বা হাঁচি পড়লে, কেউ কেউ খানিকটা বসে তারপর বাড়ি থেকে বের হন। ‘পেছন থেকে ডাকা অমঙ্গলকর’ এই কথাটাও যুক্তিহীনভাবে বিশ্বাস করেন অনেকেই। এরূপ হাজারো কুসংস্কার দৈনন্দিন জীবনে ছড়িয়ে আছে। মুখে ‘রা’ না কেটে মেনেও চলছেন অনেকে, পাছে কোন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়! জ্যোতিষশাস্ত্র মেনে অনেকে পাথর ব্যবহার করেন। আমি দেখেছি, অনেক শিক্ষিত বিত্তবান মানুষদেরও দুই হাতের দশ আংগুলে দশটি পাথরের আংটি। এই বহুমূল্যবান পাথরগুলোর বদৌলতে তারা আপন ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে আশাতীত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। অথচ দেখা যায়, প্রত্যাশিত ফললাভের চেয়ে প্রতারিত হবার সম্ভাবনা এখানে শতভাগ। কিন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনতো আর মানে না! সকলপ্রকার অকাট্য যুক্তি যে এখানে অকার্যকর! ভাবতেই অবাক লাগে, শহরাঞ্চলের আধুনিকতার মাঝে বসবাসকারী অনেকেও এই বিশ্বাস করে যে, ‘ঘুম থেকে ওঠার পর কখনো একচোখ ডলতে নেই। দু’হাত দিয়ে দুচোখ ডলতে হয়’। আজও গ্রামাঞ্চলে অজ্ঞ ও অর্বাচীন ধারণায় নিমজ্জিত মানুষজন বিষধর সাপেকাটা রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে ওঝা ডেকে বাড়িতেই ঝাড়ফুঁকে আস্থা রাখে বলেই রোগীর অসুস্থতা আরো বাড়িয়ে তাকে পরবর্তীতে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আবার কুসংস্কার ধারণ-পালনে এককাঠি সরেস! ব্রাহ্মণ প্রচলিত প্রাগৈতিহাসিক ধারণায় নিমজ্জিত এরা এখনও বিশ্বাস করে যে, পুত্রসন্তানকৃত মুখাগ্নি অথবা জলপান না করলে মৃত আত্মার সদগতি সম্ভব নয়। আর সেই অন্ধ নিয়মে বিশ্বাসের কারণেই একটা পুত্র সন্তানের জন্য পরপর সাতটা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে অনেক দম্পতি যে পরিবার পরিকল্পনার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন, তার প্রমাণও কিন্ত খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। একটা পুত্র সন্তানের মা হতে না পারার অপরাধে এখনো অনেক স্ত্রীদের কঠোর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয়। মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য, এখনো এই সমাজে বিশাল ভোজের আয়োজন করা হয়, আর তাতে নির্বোধ নিষ্ঠুর, লোকজন ‘আত্মার জন্য প্রার্থনা’ ব্যাপারটাকে সাইডলাইনে ফেলে রেখে, জমিয়ে খোশগল্পে মেতে ওঠেন, আর আড্ডা, ফটোসেশন শেষে কবজি ডুবিয়ে চর্ব্যচোষ্য খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাড়ির পথ ধরেন! কুসংস্কার নিয়ে বলতে গেলে আরো উল্লেখ করা যায়, ১৩ সংখ্যাটি অপয়া, ৪৯ সংখ্যাটি মস্তিষ্ক বিকৃতির, ৪২০ সংখ্যাটি প্রতারণার সাথে জড়িত। অথচ বিশ্বাস করার আগে কেউ এর যৌক্তিকতা নিয়ে এতটুকু ভাবে না। এখনও শ্মশান বা কবরস্থানের পাশ দিয়ে যেতে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিরও ভূতের ভয়ে গা কাঁপে। বিড়বিড় করে ঈশ্বরের নাম জপতে থাকে তারা। হয়তো নিজেরাও অবচেতনমনে জানে যে, সবগুলোই কুসংস্কার আর অবৈজ্ঞানিক ধারণা, কিন্ত এসব অবৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোই দৈনন্দিন জীবনাচরণের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যে, কোনভাবেই এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে তাদের মুক্ত করা যায় না। ‘কুসংস্কার’ একধরনের অন্ধবিশ্বাস হলেও একে সমাজজীবনের অভিশাপও বলা চলে। মনের অজ্ঞানতা, যুক্তিহীনতা আর বিবেক-বুদ্ধির অভাব থেকেই কুসংস্কার এর জন্ম। প্রকৃতপক্ষে এর পেছনে কোনরকম সত্যতা নেই। যুগযুগ ধরে লোকমুখে প্রচলিত মিথ্যা ধারণা, কিছু বানানো গল্পের মিথ্যা রটনা আর মনের অন্ধকারজনিত বিশ্বাসই এর মূল ভিত্তি। এর প্রভাবে সমাজের পাশাপাশি মানবজীবনের অনেক ক্ষতি হয়। ছোটখাটো বিষয়ে যেসব কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে তাতে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোন ক্ষতিকর প্রভাব না দেখা গেলেও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে মানবজীবনে। কুসংস্কারের প্রভাবে মনে যে সংকীর্ণতা দেখা দেয়, তা প্রতিফলিত হয় তার আচরণে, তার কাজকর্মে। যেমন, অজপাড়াগাঁয়ে এমন ধারণা আছে, ঘুম থেকে উঠে কিছুকিছু মানুষের মুখ দেখলে দিন খারাপ যায়। এর ফলে সৃষ্টি হয় মানুষে মানুষে বিভেদের আর শত্রুতার। তবে শুধুমাত্র আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশেই যে কুসংস্কারের জয়জয়কার তা কিন্ত নয়, শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতায় সমৃদ্ধ অনেক জাতির মাঝেও কুসংস্কারের অস্তিত্ব রয়েছে। দেশেদেশে অবশ্য এই অন্ধবিশ্বাসের পার্থক্য রয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, মানবমন থেকে কুসংস্কারের এই জগদ্দল পাথরটিকে সরানো যদিও খুব একটা সহজ কাজ নয়, তারপরেও সর্বস্তরের মানুষদের মনের এই অন্ধকার বিশ্বাস দূরীকরণে এগিয়ে আসতে হবে। এই লক্ষ্যে পর্যাপ্ত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে জোরপ্রচার চালাতে হবে। ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকল স্তরের মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।