বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে এবং সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্পন্সর বিজ্ঞাপনের দ্বারা ছড়ানো হেযবুত তাওহীদ নামক একটি সংগঠনের নানা প্রচারণা দৃষ্টি কেড়েছে সবার। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সংগঠনটি ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির ব্যাপারে নানামাত্রিক আপত্তি এবং ওলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ তওহিদি জনতাকে ধর্মব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে অব্যাহতভাবে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় স্বল্প হলেও সাধারণ পর্যায়ের এক শ্রেণির মানুষ তাদের এই প্রোপাগাণ্ডায় প্রভাবিত হয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন।কারা এই ‘হেযবুত তাওহিদ’?
সংগঠনটির ওয়েব সাইট ঘেঁটে দেখা গেছে এর প্রতিষ্ঠাতা টাঙ্গাইলের করটিয়া এলাকার বায়াজীদ খান পন্নী নামক এক লোক। ১৯৯৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি হেযবুত তাওহীদ নামক এই সংগঠনের জন্ম দেন। এবং নিজেকে সংগঠনটির সর্বোচ্চ নেতা ও ‘এমামুযযামান’ হিসেবে অভিহিত করেন। ২০০৮ সালে তিনি দাবি করেন, বিশেষ এক ‘মোজেজা’র মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা নাকি নিজেই তাঁকে ‘এমামুযযামান’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং ‘হেযবুত তাওহীদ’কে বর্তমান সময়ের একমাত্র সত্যাশ্রিত দল হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
অথচ ইসলাম সম্পর্কে খানিকটা ধারণা যাঁদের আছে, তারাও জানেন যে, ‘মোজেজা’ নামক অলৌকিক যে ব্যাপারটা, তা কেবল নবি-রাসুলগণের জন্যই বিশেষায়িত, নবি-রাসুলের বাইরের কারও সঙ্গে যেটা ঘটে তাকে কারামাত বলা হয়। এবং সেটা কেবল ধর্মীয় গুণাগুণে ঋদ্ধ আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের বেলায়ই ঘটে। বায়াজীদ খান পন্নীর বাহ্যিক সুরত এবং জীবনযাপন যার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তাছাড়া মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওফাতের মাধ্যমে ওহির দরোজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে, নবিজির পরে আর কেউ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো বার্তা বা সংবাদপ্রাপ্ত হবেন না।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি বায়াজীদ খান পন্নী নামক কথিত এ এমামুযযামানের মৃত্যু হয়। তাঁর পরে ‘হেযবুত তাওহীদে’র ‘এমাম’ হিসেবে দায়িত্বে আসেন হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম নামক এক ব্যক্তি। সংগঠনটির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় এই লোক নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার পোরকরা গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭২ সালে জন্ম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বিসিএস’ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার দাবি করলেও অ্যাকাডেমিকভাবে ধর্মীয় কোনো পড়াশোনা নেই তাঁর।
তাছাড়া কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে দেখা গেছে এই লোক একটি মুদি দোকানের দোকানদারি করছেন। এই ছবি যাঁরা ছড়িয়েছেন, তাঁদের দাবি, বছর দশেক আগে তিনি মুদি দোকানদার ছিলেন। মুদি দোকানের ব্যবসা থেকে বছর কয়েকের ব্যবধানে কীভাবে তিনি ‘হকপন্থী’ ‘একমাত্র’ ধর্মীয় সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে উঠলেন, তা খুবই রহস্যজনক। ধর্মীয় নেতা হয়েও ক্ষ্যান্ত হননি, ২০১২-এর পর থেকে ধর্মীয় ব্যাপারে নানা ধরনের ‘ফতোয়া’ জারি করছেন তাঁর ভক্তদের মধ্যে এবং ওলামায়ে কেরামকে ধর্মব্যবসায়ী, জঙ্গিবাদী ইত্যাদি নানা অপবাদে জর্জরিত করে অব্যাহতভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোশেশ করছেন।
উগ্রবাদ ছড়ানোর দায়ে কালো তালিকাভুক্ত সংগঠন
বর্তমানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত বক্তব্য-বিবৃতি দিলেও কয়েক বছর আগে উগ্রবাদ ও নানামাত্রিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল হেযবুত তাওহীদ নামক এই সংগঠন। হেযবুত তাওহীদ বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন সম্পৃক্ত না হন, সে-ব্যাপারে কয়েক বছর আগে একটা নির্দেশনাও এসেছিল সরকারের তরফ থেকে। ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল।
এর পরে ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ সংগঠন হিজবুত তাওহীদ বা এর কোনো অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে যোগ না দিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেসব ‘সন্দেহভাজন’ সংগঠন নিষিদ্ধকরণের পর্যলোচনার তালিকায় আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হেযবুত তাওহীদ। কয়েক বছর ধরে সংগঠনটি প্রচারণার নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। দলীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন নামে সভা-সেমিনার করছে তারা। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরসহ গণমাধ্যম অফিসে তারা তাদের প্রচারপত্র বিলি করছে। তারা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নিজেদের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করারও চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে গোয়েন্দাদের এই সূত্র থেকে।