দেশে কতগুলো জঙ্গি সংগঠন রয়েছে, তার সঠিক কোনো তালিকা নেই সরকারের হাতে। এমনকি ওই জঙ্গি সংগঠনগুলোর অর্থ কোন পাইপলাইন দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে তাও খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। অতি দ্রুত এই দুটি কাজ করতে সরকার একটি গোয়েন্দা বিভাগকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়নের নেটওয়ার্ক খুবই শক্তিশালী। সরকার মনে করে, জঙ্গিদের অর্থের ভিত ভেঙে দিতে পারলে অ্যাকশন ছাড়াই অনেকখানি দুর্বল করে দেওয়া যাবে জঙ্গি-তৎপরতা। সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, দেশের ছোট-বড় যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের আর্থিক নেটওয়ার্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। শুধু দেশের অভ্যন্তর থেকেই নয়, বিদেশ থেকেও দেদার আসছে অর্থ। এই অর্থ তারা প্রকাশ্যে কিছু সামাজিক কাজে লাগালেও মূল অর্থ খরচ হচ্ছে সন্ত্রাসের কাজে। জঙ্গিরা মূলত প্রশিক্ষণ, অস্ত্র মজুত এবং এগুলোকে কাজে লাগাতে ব্যবহার করছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংক ও এজেন্টের মাধ্যমেই অর্থ চলে যাচ্ছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে। ভবিষ্যতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামলে ফের সক্রিয় উঠবে জঙ্গি সংগঠনগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ঢুকেই সন্ত্রাস চালাবে ওই জঙ্গিরা। এমন তথ্যই রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। যে কারণে জঙ্গি সংগঠন এবং তাদের অর্থের উৎস খুঁজতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির অডিও বার্তায় বাংলাদেশে নয়টি জঙ্গি সংগঠনের জোট, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কমিটি’-এর কথা বলা হয়েছে। দৈনিক কালের কণ্ঠর তথ্যসূত্র অনুযায়ী, এই নয়টি জঙ্গি সংগঠন হচ্ছে : সোহেল মাহফুজের নেতৃত্বাধীন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), মুফতি আবদুস সালামের নেতৃত্বাধীন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি), মুফতি আবদুল হান্নানের নেতৃত্বাধীন হরকাতুল মুজাহিদীন, মুফতি আবদুর রউফের তাআমির উদ দীন, বায়েজিদ খান পন্নীর প্রতিষ্ঠিত হিযবুত তাওহীদ, মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীর আনসারুল্লাহর বাংলা টিম, মাওলানা আবদুল্লাহ মাদানির জইশ-ই-মোহাম্মদ, মাওলানা আবদুর রহমান আফগানির আনসারু বাইতিল মাকদিস এবং হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আল্লাহর দল। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ২৯টি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। তবে এ তথ্য কতটা সঠিক তা নিয়ে তাদের মধ্যেও প্রশ্ন আছে। এবং ওই সংগঠনগুলোর কাজের ফিরিস্তিও প্রকাশ করে না সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, তালেবান, আল-কায়েদাসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের শাখা রয়েছে বাংলাদেশে। তবে তাদের শনাক্ত ও নির্মূল করার মতো শক্তি বা সামর্থ্য খুবই দুর্বল নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর। জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে হরকাতুল জিহাদ বা হুজি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এটি মূলত আফগানের যুদ্ধফেরত মুজাহিদদের নিয়ে গড়ে ওঠা পাকিস্তানভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন। এ সংগঠনের মূল নেতা আফগান মুজাহিদদের অন্যতম কমান্ডার পাকিস্তানি নাগরিক সাইফুল্লাহ আখার। হুজির সঙ্গে জেএমবি, আল্লাহর দল আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের তালিকায় রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর তকমা আঁটা জঙ্গি সংগঠনগুলো চিহ্নিত করতে পারছে না গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সংবাদ সংস্থা ডয়েচেভেলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। এ কারণেই বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। মূলত ব্যাংকটির আয়-ব্যয়ের হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বৃহস্পতিবার ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার’ কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ইতিমধ্যেই ইসলামী ব্যাংক তাদের লভ্যাংশ ব্যয়ের একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে শুভংকরের ফাঁকি আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, জঙ্গিবাদের মূল উৎস হলো অর্থ। এই অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে পারলে জঙ্গিবাদ দমন অনেক সহজ হবে। আর কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত কি না, তাও গোয়েন্দারা তদন্ত করছেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ধরনের অভিযোগ আছে।’ জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ ওঠায় কয়েক বছর ধরেই চাপে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। অভিযোগের কারণে এইচএসবিসি যুক্তরাজ্য, সিটিব্যাংক এনএ এবং ব্যাংক অব আমেরিকা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির এক প্রতিবেদনেও ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ করা হয়। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ইসলামী ব্যাংকে এমন কিছু অ্যাকাউন্ট হোল্ডার পাওয়া গিয়েছিল, যাদের নাম ছিল জাতিসংঘের সন্দেহের তালিকায়। এসব অ্যাকাউন্টের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ‘লুকিয়েছিল’ ইসলামি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ‘অনিয়ম-দুর্নীতির’ অভিযোগ থাকায় ২০১০ সাল থেকেই ঐ ব্যাংকে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতও তার গবেষণায় বলেছেন, ‘ইসলামী ব্যাংক জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাংক নানা ধরনের অদৃশ্য খাতে অর্থ খরচ করে। আর মধ্যে জঙ্গি অর্থায়ন অসম্ভব কিছু নয়।’ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, ‘এরই মধ্যে সন্দেহের তালিকায় থাকা আরো কয়েকটি ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব চাওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। আর তাদের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্যও বলা হয়েছে।’ তিনি জানান, বাংলাদেশের কিছু এনজিওর কাজেও নজর রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে, কক্সবাজার, উপকূলীয় এলাকা এবং পার্বত্য এলাকায় কর্মরত কিছু এনজিওর বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নসহ নানা ধরনের অভিযোগ আছে। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলোতে ততটা নজরদারি নেই সরকারের। একাধিকবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, এনজিও ব্যুরো, এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের সন্দেহের তালিকায় থাকা এনজিওগুলোকে অর্থপ্রাপ্তি ও খরচের হিসাব দিতে বললেও গত ১০ বছরে কোনো হিসাবই জমা দেয়নি বলে জানা গেছে। সামাজিক কিছু কাজের আড়ালে অনেক এনজিও সন্ত্রাসের কাজে দেদার অর্থ ঢালছে। তাদের এই অর্থ বিনিয়োগের সব তথ্য জোগাড় করা হবে। জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থ ব্যবহারের কোনো তথ্য পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। এ ছাড়া গোপনে কোনো জঙ্গি সংগঠন তৈরি হচ্ছে কি না, তারও তথ্য নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।