Emdadul Mia

জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন সামাজিক জাগরন

জঙ্গিবাদ বা টেরোরিজম বর্তমান বিশ্বের এক জটিল বাস্তবতা। তাই এখন যৌক্তিক কারণেই জগতের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি জঙ্গিবাদ নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ গুরুত্ব পাচ্ছে। এর সূত্র ধরে ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদের নানা শ্রেণিবিভাগও তৈরি হয়েছে। যেমন সাইবার, নারকো, নিউক্লিয়ার, বায়ো, রাজনৈতিক, সেপারেটিস্ট, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ইত্যাদি।
জঙ্গিবাদ সৃষ্টির প্রধান কারণগুলো কোন পরিস্থিতিতে তৈরি হয়, তার ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অপরাধ জগতের অজস্র তথ্যবৃত্তান্ত। যেখানে সন্ত্রাস সংঘটনকারীদের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে তাদের জঙ্গিবাদী কার্যকারণ সম্পর্ক মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন সন্ত্রাস বিশ্লেষকেরা। আর সে জন্যই জিজ্ঞাসা জেগেছে, বর্তমান বিশ্বে জঙ্গিবাদের এই বিপুল উত্থান কিসের কারণে? সে কি দারিদ্র্যের কশাঘাত, ধর্মীয় উন্মাদনার যুক্তিহীন উন্মেষ, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কুটিল অভিপ্রায়, নাকি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবরুদ্ধ বিদ্রোহে?
অনেকে আধুনিক জঙ্গিবাদের মূল কারণকে রিলিজিয়াস ফ্যানাটিজম বা ধর্মীয় উন্মাদনার বিস্তার বলে বিশ্বাস করেন। ধর্মীয় উগ্রতা জঙ্গিবাদের পরিবেশ সৃষ্টিতে অনুকূল ভূমিকা তৈরি করতে অবশ্যই সহায়ক হয়। কিন্তু সেটাই কি শুধু মূল কারণ? পৃথিবীর নানা ধর্মমতে এমন অজস্র অনুসারী রয়েছেন, যাঁরা নিজেরা ধর্মান্ধ হয়েও কোনো ধরনের সহিংস নীতির প্রতি মোটেই বিশ্বস্ত নন। জঙ্গিবাদকে আদপেই নিজেদের বিশ্বাস প্রচারের অস্ত্র হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করতে পছন্দ করেন না। তাহলে জঙ্গিবাদ সৃষ্টির পেছনে কোন অন্তর্নিহিত কারণগুলো বিরাজমান?
এর নিগূঢ় উত্তর হলো, জঙ্গি মানসিকতা নিশ্চিতভাবেই সমাজের কিছুসংখ্যক মানুষের এমন এক সাইকোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য, যা শক্তিমান প্রভাবশালীদের কাছ থেকে আর্থিক, নৈতিক, আদর্শগত ও আইনগত আনুকূল্য লাভ করে মানবসমাজের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে এবং পরিস্থিতিতে একেকভাবে বাস্তবতা পায়। বাস্তবে তার সক্রিয় প্রকাশ তখনই ঘটে, যখন সেই মনস্তত্ত্ব দেশীয় শক্তি অথবা আন্তর্জাতিক মহলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।
তাই দেহ-মনের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির পেছনে যেমন কার্যকারণ সম্বন্ধ খুঁজে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দান করা চলে, জঙ্গিবাদকে সব ক্ষেত্রেই সেভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না। জঙ্গিবাদের বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ও তাই অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। যা-ই হোক, সন্ত্রাস নিমূর্লের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদের বিপুল উত্থানে বিশ্বের মধ্যে তৈরি হয়েছে আরও একটি বিশ্ব। তার নাম জঙ্গি বিশ্ব। কারণ, জঙ্গি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বজুড়ে এত বেশি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করে চলেছে তাদের সদস্য সংখ্যা, তার প্রভাব পৃথিবীর প্রতিটি কোণেই আলোড়ন তুলেছে।
বিশ্ব জঙ্গিবাদ মানবসমাজকে ঠেলে দিতে চাইছে এমন একটি অন্ধকার সময় ও স্থানের দিকে, যেখানে গণতান্ত্রিক সমাজের ধারণাগুলো বিলুপ্ত। যেখানে বিশ্বজনীন আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। সেটা তারা করতে চাইছে সমাজ কাঠামোতে ভাঙন ধরিয়ে চতুর কৌশলে মানবসমাজে বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে। সভ্য মানুষের বিশ্বাস, সংস্কার কিংবা আচার আচরণের মূলে কুঠারাঘাত দিয়ে ভয়াল বিপর্যয় ঘটিয়ে নিত্যনতুন নির্মম সন্ত্রাস, অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ড ও অরাজক পরিস্থিতিতে অসহনীয় পারিপার্শ্বিকতা তৈরি করে। যাতে নাগরিক মানুষের মনে সন্দেহ, সংশয়, আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি হয় এবং সুশীল সমাজে স্বাধীনতা ও সাধারণ মানুষের বাঞ্ছিত জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হতে হতে সামাজিক পরিবেশ জুড়ে নেমে আসে মৃত্যুশীতল বিপর্যয়। কেননা সমাজবদ্ধ মানুষের সুস্থ চেতনাই মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দেয় সুস্থতর ভবিষ্যৎ নির্মাণের দিকে। মানুষকে করে তোলে মানবিক গুণাবলির আদর্শের ধারক। মানুষকে করে তোলে অমলিন মনুষ্যত্ব বিকাশের অনির্বাণ বাহক

জঙ্গি প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি অর্জন, তাদের পরিপুষ্টি লাভের পেছনে সর্বদাই যে দেশীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় শক্তির সমর্থন থাকে, তা নয়। তবে বাস্তব সত্য হলো, অর্থনৈতিক অভিপ্রায় নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লোভ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যেই যেমন ছোট ছোট জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হচ্ছে, তেমনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আঞ্চলিক পর্যায়ে শক্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে অথবা এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপর রাষ্ট্রের প্রতিহিংসা চরিতার্থের উপায় হিসেবে এখনো কিছু কিছু রাষ্ট্র পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এদের সৃষ্টি করে যাচ্ছে আর্থিক ও নৈতিক সহযোগিতায় সমর্থন জুগিয়ে। কেননা বর্তমান জঙ্গিবাদ রাজনৈতিক আন্দোলন কিংবা আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য লক্ষ্যে পৌঁছনোর এমনই এক মোক্ষম অস্ত্র, যা ছায়াযুদ্ধ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সরাসরি সৈন্য নামিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার পরিবর্তে। তাই সর্বজনীনভাবে বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা থাক কিংবা না-ই থাক, জঙ্গিদের আইনবহির্ভূত অনৈতিক কর্মধারা থেমে নেই একেবারেই। বরং বিজ্ঞান ও নব্য প্রযুক্তির নিত্য নতুন দিক উন্মোচনের পাশাপাশি জঙ্গিদের জঙ্গিত্ব সৃষ্টির অভিনব সব কৌশলপদ্ধতি বিস্ময়কর প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে অপ্রতিহত প্রতিযোগিতার সুনির্দিষ্ট পথ ধরে। রোবোটিক, জেনিটিক, নিওরোসায়েন্স, বায়োটেকনোলজির আবিষ্কার যেমন অব্যাহত অগ্রগতিতে আমূল বদলে দিচ্ছে মানুষের জীবনধারা আর বিচিত্র জীবের পৃথিবীকে, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারে আন্ডারগ্রাউন্ডে সন্ত্রাসীরাও তাদের জঙ্গিবাদে জাগিয়ে তুলছে নতুন সৃষ্টির উন্মাদনা।
বলাই বাহুল্য, আধুনিক জঙ্গিরা নিত্যনতুন প্রযুক্তির ফসল ব্যবহারে যতখানি সিদ্ধহস্ত, উৎসাহী ও সফলকাম, সমাজের বুদ্ধিদীপ্ত সাধারণ মানুষ তার ​চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিশ্বের সব দেশের সাধারণ মানুষ ব্যবহার করার অনেক আগে থেকেই অপরাধ জগতের গ্যাং মেম্বার আর ড্রাগ ডিলাররা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল তাদের বিপার ও মোবাইল ফোন। এখন শোনা যাচ্ছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে গোপন বাক্যালাপ ও তথ্য আদান-প্রদান ও সরবরাহের কাজে নব্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তৈরি করে নিয়েছে এনক্রিপ্টেড রেডিওর মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। যে নেটওয়ার্কে নিজেদের একান্ত বিশ্বস্ত জঙ্গিকর্মী ছাড়া অন্যের অনধিকার প্রবেশ অসম্ভব। এমনকি অপরাধ জগতের সব রকম সলুকসন্ধান জানা চতুর গোয়েন্দারাও সেখানে অধিকাংশ সময়েই প্রবেশ করতে ব্যর্থ। সেই কারণেই এদের মাস্টার প্লান, প্রোগ্রাম, রুটিনমাফিক জঙ্গিদের মিটিং-কনফারেন্স সম্পর্কে জানতে কিংবা আলাপ আলোচনার বিষয়ে অবগত হতে এরা অনেক সময়েই থেকে যাচ্ছেন দুর্ভেদ্য অন্ধকারে। বিশ্ব নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে যারা কাজকর্ম করেন, আধুনিক জঙ্গিদের বুদ্ধিদীপ্ত উত্থান নিয়ে তাঁরা সোচ্চার তাই নিরন্তর। তারা বলছেন, নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিধান, যা কিনা রাষ্ট্রীয় সরকারের মূল কর্তব্য, তা এই সন্ত্রাসীদের কারণেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বারবার। কারণ জঙ্গিবাদ উদ্দেশ্য সাধনের এমনই এক হীন কৌশল, যা হিংসাবৃত্তির জিঘাংসা ছাড়া অন্য পথের অনুসন্ধান জানে না।
বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, প্রযুক্তিবিজ্ঞানের অসামান্য অবিষ্কার ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনছে সত্যি, কিন্তু তার সঙ্গে ছায়াসঙ্গী হয়ে একই গতিতে এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভিশপ্ত অন্ধকারও। কারণ, জগতের সর্বত্রই সন্ত্রাসী দলগুলো যেমন দ্রুতবেগে শিখে নিচ্ছে কীভাবে ওয়েব ও সোশ্যাল মিডিয়াকে ম্যানিপুলেট করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নিতে হয়। তেমনি এরা এর মাধ্যমে তরুণ সমাজের সঙ্গে সংযোগ সাধন করে উচ্চশিক্ষিত আধুনিক প্রজন্মকেও প্রতিদিন টেনে আনছে সন্ত্রাসবাদীদের ঘরানায়। উচ্চশিক্ষিত তরুণ সমাজ, যারা নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে অনায়াসভাবে পরিচিত এবং সিদ্ধহস্ত তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহারে, তারাও সন্ত্রাসবাদের নেশায় তা-ই জড়িয়ে পড়ছে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে তারা জর্জরিত নয়, তাদের কখনো সামাজিক বৈষম্যেরও শিকার হতে হয়নি।
সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞরা তাই জঙ্গি সম্প্রদায়ের সব কার্যকারণেরই ব্যাখ্যা খুঁজে পান না তাদের বিশ্লেষণে। কেবল এ বিষয়ে সুনিশ্চিত হয়ে ওঠেন, বিশ্বজুড়ে জঙ্গি প্রতিষ্ঠানের বিস্তার শুধু দারিদ্র্যের কশাঘাতে নয়, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবেও নয় অথবা ধর্মপ্রাণ হওয়ার কারণেও নয়। বর্তমান জগতের জঙ্গিবাদ এমনই কিছু মানবসৃষ্ট মানসিক মহামারি, যা ক্রমশই চাতুর্যের সঙ্গে পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ দাবাগ্নির মতো। পৃথিবীর পরিবর্তিত জলবায়ু যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপুল ভয়াবহতাকে ঘনিয়ে তুলছে ভবিষ্যৎ জগতের জন্য। অপরাধ জগতের ত্বরিত বিস্তীর্ণতাও তেমনি এগিয়ে দিচ্ছে বিশ্বের সমাজ-সভ্যতার বিপর্যয়কে। ড্রাগের নেশার মতো জঙ্গিবাদের হিংসÊ উদ্দীপনাও অজস্রÊ তরুণের মনে নিষ্ঠুর মাদকতার পরশ লাগাচ্ছে। ফলে জঙ্গি সংগঠনের আদর্শের প্রতি তারা আশ্বস্ত হচ্ছে। হিংস্রতার নির্মম আনন্দের প্রতি আসক্ত হচ্ছে ভয়ালভাবে।
উদ্বেগের কারণটা এখানেই আরও বেশি। কারণ, মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে মনের সুকুমারবৃত্তির পরিচর্যা দরকার। হিংসা দিয়ে যে জীবন তৈরি হয়, তাতে আর যা-ই হোক কাঙ্ক্ষিত মানবসভ্যতাকে লালন করা সম্ভব নয়। অহিংসার সাধক মহাত্মা গান্ধী তাই বলেছিলেন, অ্যান আই ফর অ্যান আই উইল মেক দ্য হোল ওয়ার্ল্ড…! এখন তাই প্রয়োজন যেকোনো জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সচেতন প্রয়াস। প্রয়োজন, এর ভয়ংকর পরিণাম সম্পর্কে সর্বস্তরের সামাজিক জাগরণ।