বাংলাদেশে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে। ছাত্রদের দাবিটা বুঝতে চেষ্টা করছি। কোটা সংস্কার অথবা কোটা না থাকা? কোটা সংস্কার যদি হয়, তাহলে তারা কি চাচ্ছে? কত % কোটা কোন ভাগে, তার কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা কি তারা সরকারের কাছে পেশ করেছে? যতটুকু জানি, আমার ভুল হলে জানাবেন, ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে কোন কোটা নেই। বর্তমানে এটা হাইকোর্টে টিকেনি। সেটাই স্বাভাবিক, কোন কোটা না থাকাটা ভাল কোন ব্যবস্থা নয়। কম বেশি পৃথিবীর সব দেশে সরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে মাইনরিটি, যোদ্ধা এবং নারীদের জন্য আলাদা কোটা থাকে।
বাংলাদেশে কোটার যে ডিস্ট্রিবিউশন সেটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক। যদিও কোটার প্রয়োগ হয় সব গুল ধাপ পার হয়ে কাজেই যারা কোটাতে নিয়োগ পাচ্ছে তারা মেধাবী নন সেটা সত্যি নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা/তাদের সন্তানদের কোটা (৩০%) কমিয়ে ১০% করা যায়, তবে নারী, অনগ্রসর জেলা, প্রতিবন্ধী এবং আদিবাসীদের জন্য অন্য ১০% রাখতে হবে। তা না হলে দু একটা জেলার লোকেরা সরকারি চাকরিতে প্রধান হয়ে উঠবে এবং এই চাকরি গুলতে পুরুষ এবং মহিলাদের সংখ্যার অনেক বৈষম্য থাকবে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলন একটা যৌক্তিক আন্দোলন। সরকার বলছে তারা হাইকোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে, ছাত্রদের নিরাশ করবেনা। অপেক্ষা করছে ভাল, এর মধ্যে একটা কমিশন গঠন করে শিক্ষার্থীদের কথা শুনে একটা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা কি তৈরি করা যায়না? এর আগেও কোটা আন্দোলন নিয়ে সময় ক্ষেপণ করে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলকে উত্তপ্ত করে ফেলেছিল। সেটার কোন প্রয়োজন ছিলনা। মনে রাখতে হবে এই আধুনিক পৃথিবীতে, সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রযুক্তির কল্যাণে এখনকার প্রজন্ম আধুনিক বিশ্বের নাগরিক। এদের চিন্তা ভাবনা এবং পালস বুঝতে হবে। এরা আপনি এবং আমাদের মত চিন্তা-ভাবনা করেনা।
এবার আসি অত্যন্ত সংবেদশীল একটা বিষয়ে। শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে আবেগ দিয়ে অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু যৌক্তিক আন্দোলন করতে গেলে অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার এটা নিয়ে মস্করা করা যায়না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুল সমস্যা হচ্ছে আত্ম পরিচয়। পৃথিবীর কোন দেশে এই আত্ম পরিচয়ের সমস্যা নেই। যুদ্ধ করে যখন একটা পরাজিত শক্তিকে সরানো হয় তখন সেই শক্তির আদর্শ নিয়ে কোন রাজনৈতিক দলের সেই দেশে কোন অধিকার থাকেনা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে এবং ক্ষমতা এবং পদের শীর্ষেও আরোহণ করেছে। কাজেই সরকার প্রধানের উক্তিতে নিজেকে রাজাকার বলে যে কোন ধরণের স্লোগান দেয়া কোন মজার ব্যাপার নয়, তাও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি কিসের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে সেটাও জানতে হবে।
পরের বিষয়টা হচ্ছে, তারা যে আন্দোলন করছে সেটা কোটা আন্দোলন না সরকার পতনের আন্দোলন? সরকার পতনের আন্দোলন করলে কোটা আন্দোলনের অধিকাংশ ছাত্র তাদের সাথে থাকবে কিনা সেটা আমার সন্দেহ আছে। এটাকে হাতিয়ার করে কেউ শিক্ষার্থীদের সাথে ভিড়ে এই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইলে অস্থিতিশীলতা হবেই। মুক্তিযুদ্ধকে জড়িয়ে ফেললে, সামগ্রিক ভাবে এই আন্দোলন পরাভূত হতে বাধ্য। তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়া সরকারকেও বুঝতে হবে কোটা বৈষম্য শুধু একটি বৈষম্য , আরও অনেক বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আছে। সুশাসন এবং জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শিক ভাবে পৌঁছান সম্ভব, শুধু চেতনা দিয়ে নয়।
এই কোটা আন্দোলনের বেনিফিসিয়ারি কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী, অধিকাংশই এই চাকরি পাবেনা। । সরকারি চাকরি গুলোতে যেমন ফিলটার আছে কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় গুলতে শিক্ষকতাতে নয়। পশ্চিমে বিশ্ববিদ্যালয় গুলতে ফ্যাকাল্টি নিয়োগে বিভাগ ভেদে নারী এবং মাইনরিটি প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, তবে সেটা শর্ট লিস্ট করার পরে। আমাদের সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গুলতে যে অসুস্থ ছাত্র রাজনীতি চলছে, তার বিরুদ্ধে এই স্কেলে ছাত্র সমাজ কখনো ফুসে উঠেনি। গনরুমে থাকছে, এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের কোন আন্দোলন দেখিনি। বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা বিদেশে পড়তে আসলে অন্যান্য দেশের ছাত্রদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকে অভিজ্ঞতায়। উন্নত গবেষণাগারের জন্য তাদের এমনকি শিক্ষকদের কোনদিন আন্দোলন করতে দেখিনি। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কখনো ফুঁসে উঠতে দেখিনি, সাম্প্রতিক কালে বুয়েট এর ঘটনা ছাড়া। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা সামগ্রিক ভাবে এটার বিপক্ষে থাকলে এবং শক্ত অবস্থানে থাকলে একটা রাজনীতি মুক্ত শিক্ষাঙ্গন বাংলাদেশে সম্ভব। একটি নিরপেক্ষ, যৌক্তিক আন্দোলনই পারে শিক্ষাঙ্গন গুলকে ছাত্র রাজনীতি মুক্ত করতে। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন গুল উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের মত পরিচালনা করতে পারলে, একটা নতুন বাংলাদেশ তৈরি হওয়া সম্ভব।
পরিশেষে বলব, যে কোন আন্দোলনে সহিংসতা কখনো কাম্য নয়, কতগুল তাজা প্রাণ চলে গেল। এদের পরিবার তাদের নিয়ে কত স্বপ্ন দেখছিল। দিনের শেষে যে পরিবার তার প্রিয়জনকে হারায় তারাই বুঝতে পারে শূন্যতা টুকু। কাজেই আবেগি না হয়ে যৌক্তিক ভাবে আন্দোলন করুন। আমার মনে হয় কোটা সংস্কারের পক্ষে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন আছে, তেমন আছে একটা রাজনীতি মুক্ত শিক্ষাঙ্গনের ক্ষেত্রে।