Emdadul Mia

উগ্রবাদ নিয়ে আসলে কী ভাবছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম

আজকের তরুণদের নিয়েই তো আগামীর পৃথিবী। তারা সৃষ্টিশীল কাজ করবে, পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের হাতেই তো থাকবে আলোর মশাল; তারা হবে সহনশীল, অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। ভালোবাসবে মানুষকে, মানবতার আদর্শ ছড়িয়ে দেবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। কিন্তু এই তরুণদেরই একটা ছোট্ট অংশকে অনেক সময়ই বিপথগামী করে তোলা হয় ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, ভুল মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে। তারা হিংসাত্মক আচরণ করে, তাদের মধ্যে দেখা যায় সহিংস উগ্রবাদিতা।

এই উগ্রবাদ নিয়ে আসলে কী ভাবছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম? কীভাবে এটি ছড়িয়ে পড়ছে? আর এ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এর প্রভাবটাই বা কেমন? প্রতিরোধের মাধ্যমে এটি থেকে উত্তরণের কি কোনো উপায় আছে? এমন সব বিষয় নিয়েই আমরা কথা বলি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বেশ কিছু তরুণের সঙ্গে।

সহিংস উগ্রবাদ কী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এস এম হোসাইন আহমেদের ভাষায়, ‘সহিংস উগ্রবাদ একধরনের ধংসাত্মক কার্যকলাপ। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ত্রাসের সঞ্চার করে কোনো বিশেষ স্বার্থ উদ্ধার করা।’

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাইজুন নাহার বলেন, ‘আমার মতে, সহিংস উগ্রবাদ মানে নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ক্ষতিকর পথ বেছে নেওয়া। এটির সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা যে শুধু অন্যের ক্ষতি করে বেড়ায় তা নয়। বরং অবাক হতে হয় এটা দেখে যে তারা নিজের ক্ষতি করে হলেও উদ্দেশ্য সিদ্ধির চেষ্টা করে।’

মাসরেফা তারান্নুম পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে, তাঁর মতে, ‘কোনো আচরণকে সহিংস উগ্রবাদ তখনই বলা যাবে যখন কারও মতাদর্শ, হোক সেটা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি, কোনো গোষ্ঠী, কোনো জাতি কিংবা কোনো নির্দিষ্ট জীবনাচরণ, যা অন্য জনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং সেখানে শারীরিক দমন-পীড়ন বা নির্যাতনের বিষয়টি থাকবে।

সহিংস উগ্রবাদের প্রভাব

সমাজে এই সহিংসতার প্রভাব কেমন?—এমন প্রশ্নের জবাব দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়া মাশায়েখ হাসান, ‘আমি মনে করি, উগ্রবাদীদের কর্মকাণ্ডের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সহিংস উগ্রবাদ বিষয়টা তাদের জন্য যেমন ক্ষতিকর, সমান ক্ষতিকর উগ্রবাদীদের নিজেদের জন্যও। আমাদের সমগ্র সমাজে এর প্রভাব অত্যন্ত খারাপ। হয়তো শাস্তি দ্বারা আমরা উগ্রবাদীদের কাছ থেকে সমাজকে সাময়িক নিরাপত্তা দিই, কিন্তু আমরা ভুলে যাই সমস্যার শেকড়ের কথা।’

মাসরেফা তারান্নুমের মতে, ‘উগ্রবাদের প্রভাব ধারাবাহিকভাবে কাজ করে। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনা ঘটতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। প্রথমত ক্ষতিটা হয় ব্যক্তির নিজের। পরের ক্ষতিটা হয় যার ওপর সহিংস আচরণ হচ্ছে তার। ধীরে ধীরে পুরো সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাবটি ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যায় নগণ্য হলেও এই গুটিকয়েক মানুষই পুরো দেশকে আতঙ্কিত করে তোলে এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে।’

সহিংস উগ্রবােদর কারণ

এত ভয়ানক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আমাদের সমাজে এই সহিংস উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ছে? এ বিষয়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমির বিজনেস ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানজিনা খান বলেন, ‘সঙ্গদোষ এবং বেকারত্বজনিত হতাশা তরুণদের সহিংস উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার দুটি বড় কারণ।’

মাসরেফা তারান্নুমের মতে, আর্থিক অসচ্ছলতাই তরুণদের উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার একমাত্র কারণ নয়। তিনি এ ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। তার মতে, অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা বা সম্মানের মনোভাব শৈশব থেকে গড়ে না ওঠা সহিংস উগ্রবাদের একটি কারণ।

সহিংস উগ্রবাদ দূর করার উপায়

সহিংস উগ্রবাদ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করে তরুণেরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মীর আকিব জাওয়াদের মতে, ‘পারিবারিক শিক্ষা ও মুক্ত মানসিকতা তৈরি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ ছাড়া ধর্ম সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞানও উগ্রবাদ প্রতিরোধ করে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজিফা তাসনিম খানম তিশা বলেন, ‘কিশোর বা তরুণেরাই সাধারণত উগ্রবাদীদের প্রধান টার্গেট থাকে। তাই সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে শনাক্ত করে তাদের যথাযথ ধারণা এবং জ্ঞান দিয়ে শিক্ষিত করা সম্ভব হলে উগ্রবাদের হার কমানো সম্ভব।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদের ভাষায়, ‘ভিন্ন মতকে স্বাভাবিকভাবে দেখে নিজের বিবেক দিয়ে যদি মানুষ কোনোকিছু বিচার করতে শেখে, তাহলেই উগ্রবাদী সহিংসতা প্রতিরোধ সম্ভব।’

তরুণদের মতে, সহিংস উগ্রবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা উন্নয়ন ও প্রগতির পথে বড় একটি বাধা। এটি প্রতিরোধে প্রয়োজন সঠিক মূল্যবোধ শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ়করণ, বহুত্ববাদে বিশ্বাস, সৃজনশীলতার বিকাশ, অন্যের মতকে সম্মান জানানো এবং সহনশীলতা। তরুণেরা ‍চায় এমন একটি পৃথিবী, যেখানে মিলেমিশে বাস করবে সবাই।